রাষ্ট্রনৈতিক পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের রাষ্ট্রনৈতিক প্রস্তাবনা

ক. ভূমিকা
আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমাদের পূর্বসূরীরা একটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু স্বাধীনের পর দেশটি কোন নীতি, কোন আদর্শে পরিচালিত হবে এবং সেই সব নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন হবে কোন আইন, কোন বিধি অনুযায়ী—সেই সব বিষয় ঠিক করার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো মতামত নেয়া হয় নাই, দেশের সাধারণ মানুষের মতামত নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল দেশপ্রেম ও কাঁচা আবেগকে প্রতারণামূলকভাবে ব্যবহার করে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে এমন একটি সংবিধান (শাসনতন্ত্র) রচনা করা হয়েছে, যা ওকালতি চাতুরীতে পরিপূর্ণ—যার প্রথম অংশে (ভূমিকা থেকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি অংশ পর্যন্ত) অনেক সুন্দর সুন্দর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে কিন্তু সেই অংশেই কৌশলে এ কথাও বলে রাখা হয়েছে যে এইসব মূলনীতি বাস্তবায়ন করা বা না করা সব হলো সরকারের ইচ্ছার বিষয়। আর মূলনীতির পরের অংশে সরকারের ক্ষমতাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে সরকার তথা সরকারের প্রধান যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন এবং তার কোথাও কোনো জবাবদিহি করতে না হয়। এ ছাড়া ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের যেসব আইন-কানুন ছিলো, তার সবকিছুকেই আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে বৈধতাও দেয়া হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র হয়ে গেছে মুখে গণতন্ত্র, আর কার্যত নিকৃষ্ট রাজতন্ত্রের চাইতেও বীভৎস—নামে স্বাধীন, কিন্তু কাজে আধুনিক ক্রীতদাসত্বের।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই জবাবদিহিহীন ক্ষমতা ও সরকার প্রধানের ইচ্ছাতন্ত্র এমনভাবে বিকশিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে যার মাত্রা এবং তীব্রতা বর্ণনা করতে হলে নতুন ভাষা নির্মাণ করতে হবে। সরকার বাজেটের নামে প্রতিবছর বাংলাদেশের ৮৪ হাজার গ্রাম আর কয়েকশ শহর থেকে পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ কোটি টাকার বেশি আদায় করে। আমরা গরুর খাবার কিনতে ট্যাক্স দেই, বাচ্চার ওষুধ কিনতে ট্যাক্স দেই, বিদেশে চাকরী করা সন্তানের সাথে ফোনে কথা বলতে ট্যাক্স দেই, কারখানার যন্ত্র কিনতে ট্যাক্স দেই, কাঁচামাল আনতেও ট্যাক্স দেই, ডিজেল কিনতে ট্যাক্স দেই, বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলেও তার ক্যাপাসিটির জন্য ট্যাক্স দেই, জমি বেচতেও ট্যাক্স দেই, এমনকি আমাদের বাচ্চাদের পরীক্ষা দিতেও ট্যাক্স দেই। এক কথায় ‘দোলনা থেকে কবর’ পর্যন্ত সকল ক্ষেত্র থেকে ট্যাক্স তুলে বা আমাদের কাঁধে ঋণের বোঝা দিয়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তারা নিয়ে নেয়। এ টাকায় তারা এমপি, মন্ত্রী, পুলিশ, মিলিটারী, জজ-ব্যারিস্টারদের বেতন দেয়, তাদের বাড়ী-গাড়ী বানায়, পেয়াদা-পাইক, চাকর-বাকর পোষে, মাসে মাসে বিদেশ যায়, দেশে-বিদেশে ঘোরে, বন্দুক কেনে, গুলি কেনে, আদালত বানায়, জেল বানায়।

এই টাকা থেকে কিছু টাকা দিয়ে তারা আমাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা বলে উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, আন্ডার পাস, ব্রিজ, স্যাটেলাইট, বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাসপাতাল, যুদ্ধজাহাজ, অস্ত্রপাতি, ওষুধপত্র ইত্যাদি বাবদ ১ টাকার জায়গায় হাজার টাকা খরচ দেখায়, অপচয় করে, দলীয় গুণ্ডা-মস্তানদের মাঝে কিছু উচ্ছিষ্ট বিভিন্নভাবে বণ্টন করে, বাকীটা আত্মসাৎ করে, পাচার করে; আর এভাবে আমাদের নদ-নদী, বন-বাদাড়, ক্ষেত-খামার ধ্বংস করে।

এইসব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এবং রাষ্ট্রীয় ও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের ইচ্ছামাফিক পরিচালনার জন্য তারা অনেক অনেক আইন বানায়, যেগুলিকে প্রধানত অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক, এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। অর্থনৈতিক আইনগুলির মাধ্যমে তারা আমাদের পরিশ্রমের টাকাপয়সা তাদের পকেটে নিয়ে যায় (যেমন বাজেট)। তাদের এই নিয়ে যাওয়ার কাজে বাধা দিলে যাতে মানুষকে থানায়-হাজতে-জেলে নিয়ে আটকে রাখা যায়, খুন করা যায়, গুম করা যায় আর বাকী মানুষদের ভয় দেখানো যায়, সেজন্য তারা প্রশাসন এবং প্রশাসনিক আইনগুলো বানায়। আর এই দুই রকমের আইন বানানো ও কার্যকর করার ক্ষমতা যাতে তাদের হাত থেকে অন্য কেউ না নিতে পারে সেই লক্ষ্যে তারা রাজনৈতিক আইনগুলো বানায় (যেমন, ভোটার হওয়া, রাজনৈতিক দল হিসাবে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া বা নির্বাচন করা, ইত্যাদি)। আর এইসব আইনের শাসনের নামে তারা সারা দেশে শাসনের আইন কায়েম করে; নাগরিকের উপর বিভীষীকা আর জুলুম পরিচালনা করে।

দেশের প্রতিটা সরকার তাদের গদি শক্ত করাকেই মূল লক্ষ্য হিসাবে নিলেও গত ২টি ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনের পরে এখন এটা সকলের কাছেই স্পষ্ট যে, এদেশে কাগজে-কলমে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে নির্বাচনের ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। একইভাবে স্বাধীন বিচার বিভাগ, স্বাধীন আইন বিভাগ, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, সাংবিধানিক অপরাপর সংস্থাসমূহসহ সকল কিছুই কাগজে-কলমে একভাবে ‘স্বাধীন’ আছে, কিন্তু কার্যত এর কোনোটারই ন্যূনতম কোনো স্বাধীনতা নাই। এছাড়া এইসব প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে এমন সব পরীক্ষিত বশংবদ, ব্যক্তিত্বহীন এবং ক্ষমতার অনুগ্রহপ্রার্থীদের বসানো হয়েছে, যারা নিজেরা সামান্য সুবিধার জন্য প্রতিষ্ঠানের সকল স্বার্থ নির্দ্বিধায় জলাঞ্জলি দিয়ে দিতে পারে। গত দুই মেয়াদের সরকার পরিচালনার নীতি এবং ধরন থেকে এটা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়েছে যে, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র সরকারের প্রধানের কাছে যে অসীম ক্ষমতা অর্পণ করেছে তাতে সাংবিধানিকভাবেই এটা এক ব্যক্তি তথা সরকার প্রধানের ইচ্ছার দাস রাষ্ট্র হিসাবে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছে। সরকার প্রধানের ইচ্ছা পূরণ করাই এই রাষ্ট্রের সকল বিভাগ, সকল প্রতিষ্ঠান এবং সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব। এটা অমান্য করার অর্থই এখানে সরকারের বিরোধিতা করা, রাষ্ট্রবিরোধী আচরণ করা। সেজন্যে এ রাষ্ট্রে নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, মান-মর্যাদা, ব্যক্তিত্বসহ যদি কেউ বেঁচে থাকতে চায় তাহলে তার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো, এই সংবিধান, এই রাষ্ট্র, রাষ্ট্র পরিচালনার আইন-কানুন, রাষ্ট্রকাঠামো, সরকার কাঠামো, সরকারের ক্ষমতা কাঠামো সংস্কার করা। সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা।

রাষ্ট্র এবং সরকারের এই জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য গত এক দশক ধরে কিছু সমমনা মানুষ কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে একটি পর্যালোচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে কাজটা শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রসংস্কারের চিন্তাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রচিন্তা নামের একটা সংগঠনের মাধ্যমে, এই কাজটা আরও বিস্তৃতি পায়। এই সময়ে এই কাজটি সম্পন্ন করার কোনো বিকল্প না থাকায়, এবং এই কাজটি করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন না থাকায়, এককথায় এই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য কোনো সঙ্গতিপূর্ণ সংগঠন গড়ে না ওঠায় ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’-এর অভ্যুদয়, যার মূল দায়িত্ব তেমন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা।

আমরা মনে করি রাষ্ট্র-সরকারকে নাগরিকদের জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসতে প্রয়োজন রাষ্ট্র সংস্কারের একটি নতুন রাজনীতি, যে-রাজনীতি আমাদের সামনে উত্থাপন করবে ৩টি বিষয় : (এক) নতুন একটি রাষ্ট্রনৈতিক প্রস্তাবনা তথা করণীয়র রূপরেখা, (দুই) সেই প্রস্তাবনা বা কর্মসূচী বাস্তবায়নের পথ ও পদ্ধতি সম্বলিত একটি কর্মপরিকল্পনা এবং (তিন) ঘোষিত কর্মসূচী ও পথ-পদ্ধতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি সংগঠন কাঠামো।

খ. রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত প্রধান প্রধান ভুল ধারণাসমূহ

নতুন রাজনীতি ও নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হলে আমাদের রাষ্ট্রের অনালোচিত ক্ষমতা কাঠামোগত দিকটায় চোখ ফেলতে হবে। নতুন রাজনীতির মূল কাজ হবে প্রথমত, দেশ পরিচালনা সংক্রান্ত আইন এবং সংবিধানকে এমনভাবে সংস্কার করা, যা এদেশের মানুষকে স্বাধীন দেশের নাগরিকের মর্যাদা দেয় এবং রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষেই জনমানুষের হাতে থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন, বাস্তবায়ন পর্যায়ের তদারকি এবং সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের শাস্তির ক্ষমতা জনমানুষের হাতে রাখার মতো আইনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বর্তমান রাষ্ট্র এবং এর সকল প্রতিষ্ঠান, আইন, আদালত, পুলিশ, মিলিটারী, প্রশাসন, সংসদ, নির্বাচন কমিশন, কম্পট্রোলার জেনারেল, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সবাই জনমানুষের পয়সায় চলে, কিন্তু সেবা করে জনমানুষের শত্রুদের। রাষ্ট্র এবং তার এইসব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের মালিকদেরকে দাস আর কর্মচারীদেরকে মালিক বা রাজা বানিয়ে রাখে, এবং এটা এমন এক কায়দায় করে যাতে মালিকেরা দাস হয়েও এ ব্যবস্থার গুণগান করতে ও শুনতে পছন্দ করে!

প্রচলিত চিন্তা ও অভ্যাসকে পরিবর্তন করে আমাদের দেশের রাজনৈতিক কর্মীদের নতুন রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় অভ্যস্ত করে তোলার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বাধা রয়েছে। যার মধ্যে একটা হচ্ছে, রাজনৈতিক বিরোধকে নেতা-নেত্রী বা বড়জোর এক দলের সাথে আরেক দলের বিরোধ হিসাবে বিবেচনা করা। রাজনীতি যে দল বা রাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি-পদ্ধতির বিষয়, সেভাবে বিষয়টা না বোঝা। দ্বিতীয় হচ্ছে, সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যকার সম্পর্ক ও পার্থক্যকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে না পারা। কর্মসূচী প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশসহ রাষ্ট্রের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানসহ সকল বিষয়কে একসাথে গুলিয়ে ফেলার মাধ্যমে প্রধান সমস্যাগুলিকে অপ্রধান করে ফেলা। সবচাইতে বড় বাধা হচ্ছে, রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিকানার প্রশ্নকে স্পষ্ট না করা।

যে কোনো তন্ত্রের মূল প্রশ্ন হলো ক্ষমতার মালিকানার প্রশ্ন। যে-রাষ্ট্রের ক্ষমতার মালিকানা সরকারের বা গোষ্ঠীর বা দলের, সে-রাষ্ট্র সরকারতান্ত্রিক বা গোষ্ঠীতান্ত্রিক বা দলতান্ত্রিক, কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতার মালিকানা জনগণের। তাই গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হলো ‘গণক্ষমতাতন্ত্র’। প্রচলিত গণতন্ত্রে এই ‘ক্ষমতা’ প্রশ্নটিকে খুব দক্ষতার সাথে আড়াল করা হয়। মুখে বা লেখায় তারা ‘রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এটা প্রচার করে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। এসব রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র (সংবিধান) এবং শাসনের আইনকে (রাষ্ট্রপরিচালনার আইন) এমনভাবে প্রণয়ন করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহ এমনভাবে গঠন করা হয় যাতে জনগণ কার্যত মালিকের বদলে দাসে পরিণত হয়।

প্রকৃতপক্ষে নাগরিকের ক্ষমতার প্রশ্নটিকে কেন্দ্রে না রেখে সরকার মন্ত্রীপরিষদ শাসিত নাকি প্রেসিডেন্ট শাসিত, সংসদ এক কক্ষ নাকি দুই কক্ষ বিশিষ্ট, সরকার এককেন্দ্রিক নাকি ফেডারেল পদ্ধতির হবে এই আলোচনা অবান্তর। আর রাজনীতির মূল প্রশ্নগুলি বাদ দিয়ে সামাজিক বা অর্থনৈতিক অজস্র আন্দোলন দিয়েও রাজনৈতিক পরিবর্তন হয় না। আমাদের শত শত নদীর মধ্যে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার প্রবাহকে যদি ঠিক করা যেতো তাহলে যেমন বাকী নদীগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা সহজ হতো, তেমনি রাষ্ট্রের শত শত কলকব্জার মধ্যে আইন (সংসদ), বিচার (আদালত) ও প্রশাসন (নির্বাহী বিভাগ), তথা সংবিধানকে যদি জনমানুষের পক্ষে আনা যেতো তাহলে রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গগুলোকেও জনমানুষের উপযোগী করা সহজ হবে।

গ. আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে

বাংলাদেশের মানুষের বহু ধরনের সরকার-ব্যবস্থা দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু থেকে বিগত অর্ধশতাব্দী কালের মধ্যে প্রবাসী সরকার, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার, বহুদলীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকার, নির্বাচিত সরকারের সংবিধান বদল করে একদলীয় সরকারে রূপান্তরিত হওয়া সরকার, সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক সরকার, সামরিক সরকারের বেসামরিকরূপে পরিবর্তিত হওয়া সরকার, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘জরুরী অবস্থার সরকার’-এ রূপান্তরিত সরকার এবং আদালতের নির্দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থার অপসারণ, ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার, ভোটারবিহীন নির্বাচিত সরকার—অর্থাৎ এদেশের মানুষ ৫০ বছর সময়ের মধ্যে যতোরকম সরকার-ব্যবস্থার অধীনে বসবাসের অভিজ্ঞতা পেয়েছে বিশ্বের মধ্যে এক অর্থে তা নজীরবিহীন।

অপরদিকে এ ভূখণ্ডের মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতাও বিপুল ও বিচিত্র। কেবল স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ দেখলেই বোঝা যাবে অহিংস-সহিংস, প্রকাশ্য-গোপন, সশস্ত্র-নিরস্ত্র, নির্বাচনমুখী-নির্বাচনবিরোধী, গণঅভ্যুত্থানপন্থী-সেনাঅভ্যুত্থানপন্থী, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও, শহরকেন্দ্রিক শ্রমিক অভ্যুত্থান অর্থাৎ আন্দোলন-সংগ্রামের যত রূপ থাকতে পারে তার প্রায় সব পথেরই চর্চা করেছে এ দেশের মানুষ। কিন্তু তাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনটি রয়ে গেছে অধরাই। তবে এ পথ-পরিক্রমা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই ভূখণ্ডের মানুষ ক্লান্তিহীনভাবে পথ খুঁজেছে এবং এখনো সে-অনুসন্ধিৎসা শেষ হয়নি।

আমাদের দেশে দুই ধরনের নির্বাচনের নজীর আছে। এক হলো সাধারণ নির্বাচন বা শুধু সরকার গঠনের জন্য সংসদ নির্বাচন (ন্যাশনাল এসেম্বলী), এবং আরেক হলো গণপরিষদ নির্বাচন বা সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচন (কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলী) সহ সরকার গঠনের নির্বাচন। গত ১০০ বছরের মধ্যে এই ভূখণ্ডে এমন ২টি নির্বাচন হয়েছে, যার সাথে গণপরিষদ নির্বাচনও একসাথে জড়ানো ছিলো। একটি ১৯৪৬ সালে এবং অপরটি ১৯৭০ সালে। কিন্তু এই দুই নির্বাচনের পরেই নতুন দেশের আবির্ভাব হবার কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বের চাইতে সরকার পরিচালনার দায়িত্বকেই প্রাধান্য দেন।

এই ভূখণ্ডের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা হলো সংবিধান বা শাসনতান্ত্রিক বা বড় ধরনের রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন মানুষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব, কালো টাকা, পেশীশক্তির দৌরাত্ম্য, সামরিক শাসন বা আদালতের রক্তচক্ষু কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না। তখন নির্বাচনকে তারা আন্দোলনে রূপান্তরিত করে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনে, যেটা সাধারণ সরকার-পরিবর্তনের নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঘটে না।

বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সাংবিধানিক (শাসনতান্ত্রিক) সংকটে। এই সংকট থেকে উদ্ধারের পথ সরকার-পরিবর্তনের-রাজনীতি বা সরকার-পরিবর্তনের-নির্বাচনের মধ্যে নেই। তাই সরকার-পরিবর্তনের রাজনৈতিক নির্বাচন কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে সেটা নিয়ে জনমানুষের উদ্বেগ বা কৌতূহল থাকলেও এর জন্য জীবনপণ লড়াইয়ে নামার আগ্রহ তারা ইতিমধ্যে অর্জিত অভিজ্ঞতার কারণে প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান বাংলাদেশ এবং তার জনমানুষের উদ্ধারের সম্ভাব্য পথ হলো দেশের আইন ও সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। আর সে-সংস্কার সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজন একটি গণপরিষদ বা সংবিধান (সংস্কার) সভার নির্বাচন।

বাংলাদেশকে সেই নির্বাচনের পথে এগিয়ে নেয়াই হলো এ সময়ের প্রধান রাজনৈতিক করণীয়। আর সেই করণীয় সাধনের জন্য প্রয়োজন ‘রাষ্ট্রনৈতিক কর্মসূচী’ প্রণয়ন, জনমানুষকে সেই কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সেই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭০ সালের গণপরিষদ নির্বাচনের মতো বিজয় ছিনিয়ে আনা। এর মধ্য দিয়েই প্রচলিত গণতন্ত্রের স্থলে ‘গণক্ষমতাতন্ত্র’ এবং গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশকে একটি ‘গণক্ষমতাতান্ত্রিক’ বাংলাদেশে রূপান্তরিত করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হবে।

ঘোষিত কর্মসূচী ও পথ-পদ্ধতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সংগঠনের রূপকল্প

আমাদের দেশে জনমানুষের রাজনীতি এবং জনমানুষের সংগঠন গড়ে তুলতে হলে এদেশের মানুষের সংগঠন ও লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তোলার অভিজ্ঞতার দুইটি প্রধান ধারার কথা মনে রাখতে হবে : (এক) স্বাধীন বা স্বতঃস্ফূর্ত ধারা, যা এই ভূখণ্ডের মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও প্রণোদনাজাত, এবং (দুই) ব্রিটিশ বা অন্য কোনো দেশের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ধারা।

ফকির-সন্ন্যাসী-পাগলপন্থী বিদ্রোহসহ বিভিন্ন কৃষক-বিদ্রোহ এবং স্থানীয় সশস্ত্র বিদ্রোহসমূহ প্রথম ধারার অন্তর্ভুক্ত। আর ব্রিটিশ-আনুকূল্যে গড়ে ওঠা কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ইত্যাদি রাজনৈতিক দলকে দ্বিতীয় ধারার উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। মূলত আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে বা নতুনভাবে গড়ে উঠছে তারা প্রায় সবাই হয় এই দ্বিতীয় ধারার মাতৃদলগুলি ভেঙ্গে জন্ম নিয়েছে, না-হয় একই মডেল অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে। এই দুই ধারার বাইরে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের মুক্তির জন্য কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করেছে আর একটি ধারা। তারাও সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশের দলসমূহকে অন্ধভাবে অনুকরণ ও অনুসরণ করেছে এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রসমূহের কমবেশী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে আর এক ধরনের দলও এ দেশে গড়ে উঠেছে। এরাও দেশী-বিদেশী কোনো-না-কোনো রাষ্ট্র বা দলের অনুকরণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট এবং পরিচালিত।

এইসব দল বা সংগঠনের গঠনপ্রণালী বা কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কতিপয় মানুষ সম্মিলিত হয়ে প্রথমে একটি দল গঠন করে কর্মসূচী ঘোষণা করছে এবং এরপর জনমানুষকে তাদের দলে যোগদান ও তাদের কর্মসূচী সমর্থনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। এভাবে গঠিত দলসমূহ প্রথম থেকেই আরোপিত নেতা আর কর্মীতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। নেতাদের পদ হয়ে যাচ্ছে স্থায়ী, সম্পত্তির মতো উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য। দল বা সংগঠনে কর্মী-অনুসরণকারীদের মালিকানা তো দূরের কথা, অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। কর্মীদের কাছে নেতাদের জবাবদিহিতার বদলে কর্মীরাই নেতাদের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য থাকার রাজনৈতিক-সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এই ধরনের দল বা সংগঠন তাদের কাগজপত্রে যা-ই লিখুক বা মুখে যা-ই বলুক, যে-দলের অভ্যন্তরে কর্মী-সমর্থকদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, সে-দলের দ্বারা কখনোই জনমানুষকে রাষ্ট্র-ক্ষমতার মালিক বানানো সম্ভব নয়। এমনকি তাদের পক্ষে জনমানুষকে রাষ্ট্রের মালিক বানানোর প্রকৃত রাজনীতিও করা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রচিন্তার পথচলায় সংগঠনের ভেতর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা সাংগঠনিক রূপ পায়। তার সাথে সাথে সংগঠনকে কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃত্বের হাতে না রেখে এবং দেশের সব ইউনিটকে সমান মর্যাদা দেবার চর্চা জারি রাখার সুবিধা-অসুবিধাও সংগঠনের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পথ চলার এই অভিজ্ঞতাকে আমলে নিয়েই রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের গঠনতন্ত্র।

রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব
বাংলাদেশের মানুষ বহুকাল ধরে, বিশেষ করে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি যে-ধরনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে, সে-রকম মানবিক ও গণক্ষমতাতান্ত্রিক একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোর ন্যূনতম যে বিষয়গুলো পরিবর্তন করা প্রয়োজন সেই বিষয়গুলোকে মোটাদাগে ৭টি ভাগে উপস্থাপন করে এইসব ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন হতে পারে তা অত্যন্ত সংক্ষিপ্তরূপে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হলো :

১. সংবিধান
এক ব্যক্তির হাত থেকে সর্বময় ক্ষমতা সরিয়ে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা কাঠামোকে জবাবদিহিমূলক করা হবে। প্রধানমন্ত্রী কোনো দলের সভাপতি বা সম্পাদক থাকতে পারবেন না এবং দুইবারের বেশী কেউ প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না এমন অনুচ্ছেদ সংবিধানে যোগ করা হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের উপর প্রধানমন্ত্রী যাতে অন্যায় কর্তৃত্ব করতে না পারে, বিভাগগুলো যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এর জন্য সংবিধানের ৪৮ ও ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করা হবে। প্রধানমন্ত্রী যাতে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন এবং কোনো গুরুতর অন্যায় বা অপরাধ করলে তাকে যাতে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া বা ইমপিচমেন্ট করা যায় এর জন্য সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ সংস্কার করা হবে।

সকল সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠান, যেমন অ্যাটর্নি জেনারেল, মহা হিসাব-নিরীক্ষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইত্যাদি যেন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, যাতে এগুলো কখনো ক্ষমতাসীন দল বা এমপি-মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর অনুগত কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সেজন্য সংবিধানের ৪৮, ৬৪, ১২৭-১৩২, ১৩৮, ১৩৯ অনুচ্ছেদ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশ সংশোধন করা হবে। বিশেষ করে সাংবিধানিক পদসমূহে নিয়োগের ক্ষমতা যাতে কোনোভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে না থাকে সেই ব্যবস্থা করা হবে।

২. সংসদ
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং সংসদের কার্য প্রণালীবিধি সংশোধন করে, উন্নয়নের দুর্বৃত্তপনা থেকে সরিয়ে সাংসদের দায়িত্বকে আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহিতা এবং বাজেট অনুমোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হবে এবং প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ করা হবে। এমপিরা যেন দলীয় প্রতিনিধি না হয়ে জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে সংসদে গিয়ে জনগণের কল্যাণের জন্য আইন বানাতে পারেন সেজন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। এই অনুচ্ছেদ এমনভাবে সংশোধন করা হবে যাতে কোনো এমপি নিজের দলের বিরুদ্ধে আনা ‘অনাস্থা বিল’ ছাড়া অন্যান্য সকল বিলে বিচার-বিবেচনা করে প্রয়োজনে বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন এবং এতে তার সদস্যপদ বাতিল না হয়। বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন এমন কোনো ব্যক্তি এমপি বা মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এর জন্য সংবিধানের ৬৬ ও ৬৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে।

এমপিদের কাজ হবে সংসদে জনগণের কল্যাণের জন্য আইন বানানো। কোনো রাস্তাঘাট-বিল্ডিং-ব্রীজ ইত্যাদি বানানো বা ধান-চাল-গম-টাকা ইত্যাদি বিলি-বণ্টনের মতো উন্নয়ন কাজে তারা যুক্ত হতে পারবেন না। প্রতিবছর এমপিদের ব্যক্তিগত এবং তাদের বৃহত্তর পরিবারের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করা হবে এবং বৈধ আয়ের সাথে কারো অসঙ্গতি ও যোগসাজশ পাওয়া গেলে তার সদস্যপদ বাতিল করা হবে এবং একই সাথে অবৈধভাবে অর্জিত সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে শাস্তি দেওয়া হবে। এর জন্য সংবিধানের ৬৬ ও ৬৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে।

সংসদে সরকারী দলের খবরদারী ও কর্তৃত্ব কমানো হবে। সকল সংসদীয় কমিটির প্রধান করা হবে বিরোধী দল থেকে। সংসদীয় কমিটিগুলো যাতে সত্যিকারে জনগণের প্রতিনিধি হয়ে নির্বাহী বিভাগের কাজের উপর নজরদারি করতে পারেন এবং জবাবদিহি চাইতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হবে। বিরোধী দল যাতে দেশ ও জনগণের কল্যাণে সংসদে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে এর জন্য সংসদীয় ‘কার্যপ্রণালী বিধির’ ব্যাপক সংশোধন করা হবে এবং সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ সংস্কার করা হবে।

জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্ন ব্যতীত জাতীয় সম্পদ ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক সকল চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে সংসদে আলোচনা বাধ্যতামূলক করা হবে। এর জন্য সংবিধানের ১৪৪ এবং ১৪৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানী, যোগাযোগ, প্রযুক্তিসহ রাষ্ট্রের সকল খাতে উন্নয়নের নামে লুটপাটের যেসব ব্যবস্থা আছে, দায়মুক্তির যেসব আইন আছে তা সম্পূর্ণ বাতিল করা হবে। রাষ্ট্রের সকল খাতে ইতিপূর্বে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যেসব চুক্তি করা হয়েছে জাতীয় স্বার্থে সেগুলোর জরুরী ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এর অনুবাদ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ থেকে পরিবর্তন করে ‘গণক্ষমতাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করা হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সীমানা এবং সাগর-নদী-পানিসহ রাষ্ট্রীয় সকল সম্পদ রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপ, বিদেশী বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি নতজানু নীতি, দেশের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেবার মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা, আর দেশের ভিতরে বিভেদ জিইয়ে রেখে বাংলাদেশকে অন্য দেশের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার পুতুল বানানোর রাষ্ট্রনীতি পরিত্যাগ করা হবে। সকল রাষ্ট্রের সাথে সমমর্যাদার ও সমঅধিকারের রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্র কখনো এমন কোনো আইন, আদেশ বা ফরমান বানানো, অনুমোদন বা জারী করতে পারবে না যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে খাটো করে।

৩. স্থানীয় সরকার
সরকারকে কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় এই দুই ভাগে ভাগ করে স্থানীয় সরকারকে স্বশাসিত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তাদের হাতে পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার ভার দেয়া হবে। স্থানীয় পর্যায়ের সকল উন্নয়ন, নির্মাণ ও বণ্টন কাজ করবে স্থানীয় সরকার। শুধুমাত্র মেগা প্রজেক্ট, জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন প্রকল্প ধরনের কিছু বিশেষ উন্নয়ন কাজ ও পরিকল্পনা করবে কেন্দ্রীয় সরকার। সংবিধানে ঘোষিত স্থানীয় শাসনকে পরিবর্তন করে স্থানীয় সরকার করা হবে। স্থানীয় সরকার যাতে স্বাধীনভাবে তার নিজস্ব বাজেট প্রণয়ন, কর সংগ্রহ ও তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন সেজন্য সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার বা এমপি-মন্ত্রী বা প্রশাসন যেন স্থানীয় সরকারের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে তার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা কোনো গুরুতর অন্যায় বা অনিয়ম করলে তাদের ‘প্রত্যাহার বা রিকল’ করার এবং শাস্তির আইন করা হবে।

ভ্যাট, আয়কর ও শুল্ক থেকে রাষ্ট্রের আদায়কৃত অর্থের সিংহভাগ স্থানীয় সরকারের অধীনে খরচ করা হবে। জনগণের উপর ট্যাক্স নির্ধারণ ও রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের অগণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তনের জন্য সংবিধানের ৮০ থেকে ৯২ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। ট্যাক্স আইন এমন করা হবে যাতে ব্যবসা বা আমদানীর চেয়ে উৎপাদন লাভজনক হয় এবং ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের চেয়ে আয়করের মতো প্রত্যক্ষ করের উপর নির্ভরতা বাড়ানো সম্ভব হয়।

৪. নির্বাচন
সংসদে বড় দলের শক্তির ভারসাম্য নিশ্চিত করতে, সংসদের আসন সংখ্যা পাঁচশতে বাড়িয়ে অতিরিক্ত দুইশ আসনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা হবে। বর্তমান জাতীয় নির্বাচনী-ব্যবস্থা পাল্টে মিশ্র নির্বাচনী (এলাকাভিত্তিক বিজয়ী ও সংখ্যানুপাতিক) ব্যবস্থা চালু করা হবে। জাতীয় সংসদে এমপি হবার জন্য প্রচলিত এলাকা ভিত্তিক সর্বোচ্চ ভোটে বিজয়ী প্রার্থীর পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় কোনো দল বা জোট সারাদেশে যতো ভোট পাবে তার অনুপাতে সংসদে তাদের আসন বণ্টনের ব্যবস্থা করা হবে—যাতে করে সন্ত্রাস, অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত হয়ে জনগণ প্রতিটা দলের কর্মসূচী ও অঙ্গীকার দেখে-বুঝে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন। এর জন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হবে এবং নির্বাচনী আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে।

নির্বাচন কমিশন যেন সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়াতে পারে, এটা যাতে কখনো কোনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা মন্ত্রী-এমপি বা প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবাহী দাসে পরিণত না হতে পারে, জনগণ যাতে সবসময় তার পছন্দের প্রার্থীকে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন সেজন্য সংবিধানের ৪৮ এবং ১১৮ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সক্ষম হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আদলে, জাতীয় সরকারের অধীনে যেনো নির্বাচন হতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হবে।

৫. আইন, বিচার এবং প্রশাসন
জন হয়রানির আইন-আদালত-পুলিশ ব্যবস্থা সংস্কার করে, পুলিশ ও আদালতকে নাগরিকের নিরাপত্তা, শান্তিশৃঙ্খলা এবং ন্যায়বিচারের আশ্রয়স্থল হিসাবে গড়ে তোলা হবে। যেসব আইনী মারপ্যাঁচের কারণে অন্যায় করেও ক্ষমতাবানরা শাস্তি পায় না সেগুলোর সংস্কার করা হবে। যেসব আইনী পদ্ধতির কারণে বিচারক ন্যায়বিচার করতে পারেন না, নিরপরাধ সাজা পায় আর দোষীরা ঘুরে বেড়ায়, কিংবা বিচারক ‍নিজেই অবিচার করার সুযোগ পান, বা বিচারকাজ দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকে, মিথ্যা সাক্ষী সত্য হয়ে যায়—সেইসব পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। এর জন্য পদ্ধতিগত আইন (প্রসিডিউরাল ল) এবং স্বাক্ষ্য আইনকে পরিবর্তন করা হবে। বিচারবিভাগ যেন সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে পারে, উচ্চআদালত ও নিম্নআদালতের উপর যাতে কখনো কোনো সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেজন্য সংবিধানের ৪৮, ৯৫, ৯৬, ৯৭, ১১৩, ১১৪, ১১৬ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।

প্রশাসননহ সকল সরকারী অফিসকে দক্ষ, জনসম্পৃক্ত এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। এর জন্য সকল বিভাগীয় দুর্নীতির তদন্ত ও সাজার আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। ডিসি-এসপিসহ জেলার সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ স্ব স্ব স্থানীয় সরকারের কাছে জবাবদিহি করবেন। এর জন্য সংবিধানের ১৩৩-১৩৬ অনুচ্ছেদ এবং সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের বাঙালি ভিন্ন জাতিসত্তা, নারী, প্রতিবন্ধীর জন্য প্রয়োজনীয় কোটা রেখে সরকারী চাকরীতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করা হবে।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের পুলিশ বাহিনী ও পুলিশের আইন রাখা হবে না, পুলিশ বাহিনীর নাম পাল্টে ‘জননিরাপত্তা বাহিনী’ রাখা হবে। স্বাধীন দেশের নাগরিকের সেবা করার উপযোগী জননিরাপত্তা বাহিনী ও বাহিনীর আইন বানানো হবে। সেজন্য ব্রিটিশের বানানো পুলিশ রেগুলেশন, ১৮৬১ সালের পুলিশ অ্যাক্ট এবং ১৯৮৪ সালের সামরিক সরকারের বানানো মেট্রোপলিটান পুলিশ আইন ও পরবর্তী সময়ে বানানো র‌্যাব আইনসহ বিদ্যমান সকল পুলিশী আইনের সংস্কার করা হবে, যাতে জননিরাপত্তা বাহিনী হয়ে উঠতে পারে নাগরিকের নিরাপত্তার আশ্রয় এবং সম্মানের প্রতীক। নাগরিকের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত প্রত্যেকটি জেলার জননিরাপত্তা বাহিনী থাকবে সেই জেলার স্থানীয় সরকারের অধীনে। তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বেতনভাতাসহ সকল কিছু স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে থাকবে। জননিরাপত্তা বাহিনী যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং সরকার, এমপি, মন্ত্রী, নেতা বা প্রশাসন যাতে তাদের উপর কোনো অন্যায় প্রভাব খাটাতে না পারে সেভাবে আইন বানানো হবে এবং সংবিধানের ৩২, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কেবলমাত্র ‘স্পেশাল রিজার্ভ ফোর্স’ থাকার ব্যবস্থা রেখে নতুন আইন বানানো হবে।

৬. মৌলিক অধিকার
রিমান্ড, র‌্যাব এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা সহ সকল নাগরিক অধিকার বিরোধী আইন বা প্রতিষ্ঠান বাতিল করে নাগরিকদের বলবার, পড়বার, চলবার, ভাববার এবং একদল হবার স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়াকে রাষ্ট্রের কাজ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। মত প্রকাশের অধিকার, জীবনের অধিকার, ধর্মীয় অধিকার, জাতিসত্তার অধিকারসহ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান নাগরিক অধিকার ও মৌলিক অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক যেসব বাধা আছে তা দূর করা হবে। এ জন্য সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদসমূহকে ‘শর্তসাপেক্ষে’র বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নিরঙ্কুশ করা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নাগরিক-অধিকার ও মৌলিক-অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক সকল আইন সংস্কার করা হবে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, বিনোদন এবং নিরাপত্তার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে সংবিধানে গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্র কখনো এমন কোনো আইন, আদেশ বা ফরমান প্রণয়ন, অনুমোদন বা জারী করতে পারবে না, যা ব্যক্তির মৌলিক মানবিক অধিকারকে গৌণ, হস্তক্ষেপ বা লঙ্ঘন করে ।

স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-কিন্ডারগার্টেন-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী যাতে মানসম্মত শিক্ষা পায় তা রাষ্ট্র থেকে নিশ্চিত করা হবে। গবেষণা, জ্ঞানবিজ্ঞানে অগ্রগতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মানবিক ও সৎ মানুষ তৈরীর লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো হবে। যে সকল আইন ও বিধিবিধানের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর সরকার, দল বা প্রশাসন অন্যায্য কর্তৃত্ব করে তার অবসান ঘটাতে আইন ও বিধির প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। উচ্চশিক্ষাকে সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী এবং সরকারের কর্তৃত্বমুক্ত করতে তিহাত্তরের অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে এবং এটাকে পাবলিক ও প্রাইভেটসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কার্যকর করা হবে। শিক্ষা খাতের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, নিয়োগ ও বেতনকাঠামো সম্পূর্ণ পৃথক করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বানানো হবে। সংবিধানে শিক্ষাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং শিক্ষা খাতে ব্যয়কে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‍বিনিয়োগ হিসাবে ঘোষণা করা হবে। কর্মক্ষম ও দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মানুষ যাতে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে মানসম্মত চিকিৎসা পায় রাষ্ট্র থেকে তা নিশ্চিত করা হবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকে সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করা হবে। কোনো হাসপাতাল-ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র যেন মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে অবহেলা করতে না পারে এবং তাদেরকে অযাচিত খরচের ফাঁদে ফেলতে না পারে তার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। জনগণের প্রয়োজনীয় ইম্যুনিটি তৈরিতে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে সকল প্রকার খাদ্য ভেজাল ও বিষমুক্ত করতে আইনের ফাঁকফোকর দূর করা হবে। পাশাপাশি বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ ও দৃশ্যদূষণ দূর করতে আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। চিকিৎসামুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা নয়, রোগ প্রতিরোধমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে বর্তমান ওষুধ প্রশাসন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে।

দেশের প্রাণ প্রকৃতিকে দেশের উত্তরসূরীদের জন্য হেফাজতে রাখাকে রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করা হবে। সমতল, পাহাড়, উপকূল, হাওড়, বিল, নদী, চরাঞ্চল, বন সহ সারাদেশের প্রত্যেকটি এলাকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বুঝে স্থানীয় জনগণ এবং স্থানীয় সরকারের মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার আইন করা হবে। দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ এবং প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কোনো উন্নয়ন উদ্যোগ যাতে গ্রহণ করা সম্ভব না হয় সেজন্য বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করা হবে। স্থানীয় জনগণ ও স্থানীয় সরকারের মতামত না নিয়ে সরকার যাতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ করতে না পারে সেজন্য সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। দলীয় বিবেচনায় মাফিয়াদের কাছে খাস জমি বরাদ্দ দেয়ার বদলে জমি ব্যবহারকারী উৎপাদক ও ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সংবিধানে ঘোষিত ৩ ধরনের মালিকানার বদলে ৪ ধরনের মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া হবে।

৭. অর্থনীতি
নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা সেবা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক রেখে ব্যক্তি খাতকে রাষ্ট্রীয় হয়রানি থেকে মুক্ত, সুস্থ প্রতিযোগিতাবান্ধব রেগুলেশনের আওতায় আনা হবে এবং সরকারের যথেচ্ছা কর বৃদ্ধি, অপচয় ও পাচার বন্ধ করা হবে। ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজারসহ অর্থনীতির সকল খাতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুটপাট ও পাচার করার সুযোগ বন্ধ করা হবে। এর জন্য ব্যাংক কোম্পানী আইন, কোম্পানী আইন, স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিস সংশ্লিষ্ট আইন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল ফাংশনস অ্যাক্ট, অডিট অ্যাক্ট-১৮৬০, মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, দেউলিয়া বিষয়ক আইন, রুলস অব বিজনেসসহ সংশ্লিষ্ট অপরাপর আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর সরকারের অন্যায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স ডিভিশন’ বিলুপ্ত করা হবে। ব্যাংক দেউলিয়াকরণ এবং ঋণ নিয়ে বিনিয়োগের নামে আত্মসাৎ ও অর্থপাচার প্রতিরোধ করতে ব্যাংক আইন এবং ব্যাংক ঋণ ম্যানুয়েলসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে।

রাষ্ট্রের কোনো দপ্তরে যেন কোনো প্রকৃত উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার না হয় এবং তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা যেনো সকল অবস্থায় নিশ্চিত থাকে এর জন্য বিদ্যমান আইনের সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সকল কিছু করা হবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান করার আইন করা হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় তথ্য নিয়ে দেশে এবং বিদেশে কোনো সন্দেহ তৈরী না হয়।

কৃষি-শিল্পসহ সকল শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় ন্যূনতম মজুরী ঘোষণা করা হবে। কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অবাধ আমদানীর প্রভাবসহ ফসল উত্তোলন, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় ও গুদামজাতকরণের পথে সেসব হয়রানি ও বাধা আছে তা দূর করা হবে। পাট, আখ, চা-সহ সকল কৃষিভিত্তিক শিল্পকে অলাভজনক করার যেসব অপব্যবস্থা চালু রাখা আছে তা বন্ধ করা হবে এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিদেশ গমনে ইচ্ছুক শ্রমিকদের বিনাখরচে প্রশিক্ষণসহ স্বল্প খরচে ও বিনা হয়রানিতে সকল সেবা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে তা দূর করা হবে। বিমানবন্দরসহ সর্বত্র প্রবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে ও বিদেশের কর্মক্ষেত্রে হয়রানি থেকে তাদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় আইন তৈরী করা হবে।