সংস্কার এখন জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি

 

 

সংস্কার-এখন-জাতীয়-ঐক্যমত্যের-ভিত্তি

 

হাসনাত কাইয়ুম। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক। জন্ম ১৯৬৩ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার শোভারামপুর গ্রামে। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, রাষ্ট্র সংস্কার এবং আগামী দিনের জাতীয় ও দলীয় রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের দীপক দেব।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : রাষ্ট্র সংস্কারের যে ধারণা একসময় আপনারা দিয়েছেন এবং প্রচার করেছেন, সেটা আজকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণদাবিতে রূপান্তর হয়েছে। বিষয়টিকে আপনারা কীভাবে দেখছেন? এখানে আপনাদের কী ধরনের ভূমিকা ছিল?

হাসনাত কাইয়ুম : এটা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের, একই সঙ্গে গর্বের। আমরা প্রথমে যে বিষয়টা চিহ্নিত করেছিলাম, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বহুবার বহু ধরনের আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে এবং জনগণ বহুবার বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু কখনই সেই বিজয় তাদের হাতে থাকেনি, সেটা বেহাত হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের মতো এতবড় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামও বেহাত হয়ে গেছে। সেই সংগ্রামের ফল জনগণের হাতে আসেনি। এটা কেন হয়? এর মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করি যে, আমাদের এখানে ব্রিটিশ কলোনি যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল; অর্থাৎ এখানকার জনগণকে দমন করে শাসন করার জন্য এবং এখানকার সম্পদ সংগ্রহ করে তার নিজের দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে আয়োজন ছিল, সেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোটা কখনও প্রশ্নের মুখে পড়েনি। সেই জায়গা থেকে আমাদের মনে হয়েছে, ’৭১ সালে যে রাষ্ট্র কাঠামোটা গঠন করলাম, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা হলো, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করা হলোÑ সেটা আসলে ব্রিটিশদের চেয়েও অধঃপতিত বা আরও বেশি দমনমূলক হলো। ক্রমাগত এটা দমনমূলক হয়ে যাচ্ছিল। আমরা দেখতে পাই, আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্র কাঠামোর একটা বৈপরীত্য আছে। এটাকে সাযুজ্যপূর্ণ করতে হবে। অর্থাৎ আপনার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যদি ক্ষমতা কাঠামোকে সংগতিপূর্ণ করতে পারেন, তাহলে এখানে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র কিছুটা পক্ষে আসতে পারে। সেই জায়গায় কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো নির্ধারণ করা আছে, সেখানে পরিবর্তনের খুব বেশি দরকার নেই। ক্ষমতা প্রশ্নটা নিয়ে মানুষের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করা সম্ভব। কারণ গত ৫৩ বছরে বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা ও ভোগান্তি হয়েছে। সেই জায়গা থেকে আমরা বললাম, ক্ষমতা কাঠামোকে সংস্কার করে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপযোগী করে তুলতে হবে। সেই জায়গা থেকে প্রথমে আমরা সংবিধানের মধ্যে ক্ষমতা কাঠামোর অসংগতিগুলো নিয়ে একটা পর্যালোচনা করি। এই চিন্তার জায়গা থেকে ‘রাষ্ট্র চিন্তা’ নামে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক এক ফোরাম করি। ওখান থেকেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো সারা দেশে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা শুরু করি। কোনো রাজনৈতিক দল এগুলো তাদের কর্মসূচিতে গ্রহণ না করায় নিজেরাই এটি বাস্তবায়নের জন্য ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটা সংগঠন গঠন করে কাজ শুরু করি। শুরুতে এটা সংবেদনশীল মধ্যবিত্তের মধ্যে ছড়াতে থাকে। পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক সহযোগীদের ( যেমন, গণতন্ত্র মঞ্চ) সঙ্গে কাজ শুরু হয়। বিএনপি সঙ্গে যখন গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে, তখন বিএনপি সেটাকে গ্রহণ করে। এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধারণার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়। এবার যখন ছাত্ররা আন্দোলনে গেল, বিশেষ করে যখন এক দফায় গেল, তখন তারা দেখল কেবল হাসিনার পতন নয়, হাসিনা যে কারণে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছে সেই রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার করতে হবে,  যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ যেন আর ফ্যাসিবাদী হয়ে না ওঠে। এটা আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকেই বলছিলাম। কিন্তু ছাত্রদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এটা এখন জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। এটা এখন জাতীয় ঐকমত্যের একটা ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : কোন কোন জায়গায় এবং কোন কোন পদ্ধতিতে করতে হবে?

হাসনাত কাইয়ুম : রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে আলোচনা হলেও কোন কোন জায়গা থেকে কোন কোন পদ্ধতিতে এই সংস্কার করতে হবে এবং পদ্ধতি কী হবে, সেটার বিষয়গুলো আমরা এখনও জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারিনি। কিন্তু এটা সময়ের প্রয়োজনেই মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। আমরা মনে করি, যেহেতু আমরা মনে করছি, একটা সংস্কার প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে জাতি যেহেতু একমত হয়েছে, এখন কোন পথে সেটা হতে হবেÑ সেটা নিয়েও আমরা একমত হতে পারব।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : আপনাদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখনই কাজ শুরু করা দরকার?

হাসনাত কাইয়ুম : আমরা দুটো জায়গা বলেছি, পদ্ধতিগত জায়গা থেকে এই রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান জায়গাগুলো, যেমন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও প্রশাসন, এই তিনটাকে একটা মৌলিক কাঠামো বলা হয়। আমরা বলি, এগুলোকে একটু ভাগ করলে ১০ থেকে ১২টা জায়গা পাবেন। আমরা ৭ দফা প্রস্তাব দিয়ে আমাদের রাজনীতি শুরু করেছিলাম। আমরা বলি, সংস্কারের দুইটা জায়গা আছে, একটা হচ্ছে মৌলিক জায়গায় সংস্কার করতে হবে, আরেকটা হচ্ছে আপনি ডালপালা সংস্কার করতে পারেন। রাষ্ট্রের যে জায়গাগুলো সংস্কার করলে জনগণের অধিকারের জায়গাগুলো নিশ্চিত হবে সেই জায়গাগুলোকে আমরা মৌলিক সংস্কারের কথা বলছি। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে বলছি ব্যবহারিক সংস্কার। সেই মৌলিক জায়গার সংস্কারের জন্য আপনি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলাদা আলাদা করে ট্রাস্কফোর্স করতে পারেন। ধরেন বিচার বিভাগ, এখানে কী কী সংস্কার করা হবে, এটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত তিন মাসের মধ্যে দিতে বলেন। আরেকটা হতে পারে, গণপরিসরে আলোচনা। এখানে অ্যাডভোকেট, ভুক্তভোগী, সাধারণ জনগণ ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসতে পারেন। আমরা এটাকে বলছি গণআলোচনা।

আমরা বলছি, ১২/১৪টা টাস্কফোর্স গঠন করেন। তারা একদিক থেকে রিপোর্ট দেবে সরকারকে, আর আরেক দিক থেকে গণআলোচনা শুরু হোক। জনগণ কিরকম রাষ্ট্র চায়, কীভাবে চায়, কীভাবে হলে মানুষ মনে করবে সেটার মধ্যে তার মতামত গেছে, সেটা নিয়ে গণআলোচনা করুক। সেই গণআলোচনা ও ট্রাস্কফোর্স, এই দুইটা থেকে যে মতামত আসবে, সেখান থেকে কমন মিনিমাম জিনিস পাওয়া যাবে। মিনিমাম যে কমন ঐকমত্য পাওয়া যাবে, সেটাই হবে জাতীয় ঐকমত্যের জায়গা। এই ঐকমত্যের জায়গাটাকে ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে টার্গেট করেন। এটা পাওয়ার পরে বলেন যে এটুকু আমরা কমন জায়গা পেয়েছি, আমরা সংবিধানের এটুকু সংস্কারের জন্য সংবিধান সংস্কারসভা নির্বাচন করতে চাই। এরা শুধু মাত্র এই সংবিধানের সংস্কার করার জন্যই নির্বাচিত হবে। তাদের নির্বাচিত করে নেওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে সংবিধানের ভাষাটাকে ওই সংস্কারের রূপরেখার সঙ্গে মিলিয়ে সংস্কার করবে। ওই ড্রাফট রেডি করে জনগণের কাছে গণভোটের জন্য দিয়ে দিলে এটা হবে সর্বজনস্বীকৃত এবং গ্রহণযোগ্য এবং শান্তিপূর্ণ একটা সংস্কার।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : এই সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখেন কি না?

হাসনাত কাইয়ুম : তারা যদি সকলের কাছে সদিচ্ছার বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারেন, তাহলে সমাজের সকলের সহযোগিতা পাবে, এখানে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখি না। কম প্রয়োজনীয় বিতর্কগুলো বাদ দিয়ে অধিকতর প্রয়োজনগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার করলে কোনো বিতর্ক হবে না। রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সমাজে ইউনিটি প্রতিষ্ঠিত হবে। সুন্দর বাংলাদেশের দিকে যেতে পারব।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : সময় কতদিন লাগতে পারে বলে মনে করেন?

হাসনাত কাইয়ুম : আমাদের সঙ্গে সরকার বসলে আমরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব। সরকার আন্তরিক হলে সংস্কারের জন্য দেড় থেকে দুই বছরের বেশি লাগবে না। আমার ধারণা ৫৩ বছরের জঞ্জাল সরানোর জন্য সাধারণ মানুষ এই সময়টা দিতে রাজি থাকবে। সরকার প্রয়োজনীয় কাজ করছে এবং অহেতুক সময়ক্ষেপণ করছে না, এই ধারণা যদি সবার কাছে দিতে পারে, তাহলে কোনো দলই অন্যায্য কোনো দাবি তুলতে পারবে না। আমাদের উচিত যারা আমরা এই সংস্কার চাই, তাদের এই সরকারকে সেই কাজে পূর্ণ সমর্থন করা।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : সংস্কারকে টেকসই করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

হাসনাত কাইয়ুম : দেখতে হবে, যাদের জন্য এই সংস্কার করা হচ্ছে সেই রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে গ্রহণ করার জন্য মানসিকভাবে ও সংস্কৃতিগতভাবে প্রস্তুত আছে কি না! না হলে সংস্কার করলেও একটা দল ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছর পর দেখল যে, এগুলো তার সঙ্গে যায় না, তখন তারা এটা নস্যাৎ করার জন্য বিভিন্ন পাঁয়তারা করতে পারে। এ ছাড়া পদ্ধতিগত ত্রুটিও যেন না থাকে সেটার দিকেও নজর রাখতে হবে। যে কেউ চাইলেই যেন এই সংস্কার পরিবর্তন করতে না পারে। এজন্য সব ধরনের প্রতিনিধি নিশ্চিত করে রিফর্ম অ্যাসেম্বিলির মধ্যদিয়ে সংবিধান সংস্কার করতে হবে। এজন্য যাদের জন্য সংস্কার তাদের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য করে তোলা দরকার। একই সঙ্গে রক্ষাকবচগুলো ভালো করে সেট করা। দেখুন, দেশের বড় দুইটা দলের সংস্কৃতি হচ্ছে পরিবারতান্ত্রিক। রাষ্ট্র যখন স্বৈরতান্ত্রিকভাবে চালাতে পারবেন না, গণতান্ত্রিকভাবে চালাতে হবে তখন দলের মধ্যেও এর প্রভাব পড়বে। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে চাপ তৈরি হয়েছে দলের মধ্যেই এই চাপ পড়তে বাধ্য। বাইরের পরিবর্তন ও রাজনৈতিক দলের ভেতরের পরিবর্তন দিয়েই সংস্কার টেকসই করা যাবে। সমাজে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আরেকটা সময় এসেছে,  এটা সবাইকে মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : দল হিসেবে রাষ্ট্র-সংস্কার আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

হাসনাত কাইয়ুম : স্বপ্নের যে দেশ সেই দেশ যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তাহলে সেই দেশ পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র-সংস্কার আন্দোলন অংশ নিতে চাইবে। সংস্কার কার্যকরের কাজ আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। আর দুর্ভাগ্যক্রমে যদি আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে তারপরও সেই লড়াইকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে যাব। একেকটা মৃত্যু প্রতীক হয়ে ওঠে। আবু সাঈদের মৃত্যুর পরে মানুষ আগের বাংলাদেশে যে থাকবে না, এটা যে একটা নতুন বাংলাদেশ হবে এবং সেই বাংলাদেশ সংস্কার হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ হবে,  তা নির্ধারিত হয়ে গেছে। এটাকে আসলে থামানো যাবে না।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : আপনাকে ধান্যবাদ।

হাসনাত কাইয়ুম : আপনাকেও ধান্যবাদ।

নিউজ সোর্সঃ https://protidinerbangladesh.com/national/111884

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *