ভারতীয় উপমহাদেশের উচ্চ-আদালতের রাজনৈতিক ভূমিকা

ভারতে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৭৭৩ সালে, কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে, কোম্পানির আমলে । এর আগে ভারতের পুতুল সম্রাটের কাছ থেকে প্রথমে দেওয়ানী এবং শেষ পর্যন্ত ফৌজদারি বিচারের ক্ষমতাও নিয়ে নেয় কোম্পানি ।

কোম্পানির কর্মচারী ওয়ারেন হেস্টিংস এর সাথে মহারাজ নন্দকুমারের দ্বন্দ্বটি বেশ পুরনো : ১৭৬৫ -এর দিকে মুর্শিদাবাদের দেওয়ানী আদায়ের সুযোগ পাওয়া নিয়ে। সে যাত্রায় হেস্টিংস নবাবের প্রিয়পাত্র নন্দকুমারে কাছে হেরে যান।

কিন্তু পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেষ্টিংস ১৭৭৪ সালে গভর্নর জেনারেল হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর, তার স্কুল জীবনের বন্ধু এলিজা ইম্পেকে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রথম চীফ জাস্টিস হিসাবে নিয়োগ দিয়ে ভারতে নিয়ে আসেন ।

অভিযোগ আছে ভারতে ‘ঘুষ’ বিষয়টি প্রথম চালু করেন হেস্টিংস । এর আগে পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়ার আশায়, ভারতে রাজ-রাজাদের প্রকাশ্যে ‘ভেট’ দেওয়ার প্রথা চালু ছিলো কিন্তু গোপনে ‘ঘুষ’ দেওয়ার কোন চল ছিলো না । মীর জাফরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী মুন্নী বেগমকে ঘুষ দেওযার অভিযোগ তুলেছিলেন নন্দ কুমার। এই ঘটনার প্রমাণ হিসাবে একটি চিঠিও জমা দিয়েছিলেন তিনি কাউন্সিলের কাছে কিন্তু ইংরেজ কাউন্সিল সে অভিযোগ আমলে নেয়নি।

অব্যাহতি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই একজন ভারতীয়র মাধ্যমে নন্দ কুমারে বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার ৪ বছর আগের একটি জালিয়াতির অভিযোগে মামলা দায়ের করানো হয় । ভারতীয় আইনে জালিয়াতির শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকার পরও তার বাল্যকালের বন্ধু সেই চীফ জাস্টিসকে দিয়ে ফাসির আদেশ দেয়া হয়। আপীল করার সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি করে ১৭৭৫ সালের ৫ আগস্ট ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বলা যায়, খুন করা হয়। ব্রিটিশ-ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এটাই প্রথম জুডিশিয়াল কিলিং। ঘটনটি ‘জুডিশিয়াল কিলিং’ হিসেবে স্বীকৃতও হয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণের কোর্ট হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রমাণও রেখেছে, এ বিষয়টার স্বীকৃতি তো পরের কথা, তেমন করে আলোচনাও হয়নি।

ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পরও সুপ্রিম কোর্টের মুল বৈশিষ্ট্যের কোন পরিবর্তন হয়নি । ভারতের সরকারে আছে- এমন কোনো রাজনৈতিক দল যখনই হিসেব করে দেখেছে তাদের কোন জটিল এজেন্ডা, নিজেদের রাজনৈতিক শক্তিতে বাস্তবায়ন করা কঠিন, কিন্তু বাস্তবায়িত করতে পারলে তারা লাভবান হবে, তখনই প্রায় বিনা ব্যতিক্রমে উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে।

‘আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প’র মতো একটি অভাবনীয় পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্প বাস্তবায়ন কিংবা নিজ দেশের নাগরিকদেরকে নিজ দেশে অকারণে বন্দী করার মতো জঘন্য, হিংস্র, জাতি-বিদ্বেষী, সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তারা অনায়াসে সুপ্রিম কোর্টকে ব্যবহার করতে পেরেছে। সদ্য প্রদত্ত বাবরী মসজিদ মামলার রায় দেখলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এ বৈশিষ্ট্যটি বুঝতে পারবে । পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টতো রাজনৈতিক দল এবং সরকারের অভিভাবক সেজেই বসেছে।

বাংলাদেশ বিষয়ে কি আলাদা করে আলাপ করার আর প্রয়োজন আছে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *