বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ, ছাত্র রাজনীতি ও আবরার

  • লেখক: পার্থ প্রতীম দাস

প্রায় একসঙ্গেই নানা প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মুখর হয়েছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারী উপাচার্য। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তবে গত কয়েকদিন এগুলো ছাপিয়ে আমাদের মনোজগৎ আচ্ছন্ন করে ছিল একটি নাম। আবরার। স্বাধীন মতপ্রকাশের দায়ে যাকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এরপর আন্দোলন হলো, অনেকেই গ্রেপ্তার হলো, জানা গেল কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে উঠেছে টর্চার সেল; কিভাবে শিক্ষার্থীদের হীনমন্য, দাস বানিয়ে রাখার জন্য প্রবল ক্ষমতা প্রয়োগ করা হচ্ছে সরকার ও প্রশাসনের মদদে। এবং সবশেষে বুয়েটে দ্বিতীয়বারের মতো (এর আগে ২০০২ সালে) সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে আন্দোলন স্থগিত করা হলো।

বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারী ভিসির স্বেচ্ছাচার অনেকদিন ধরেই চলছিল। এবার তার গদি ধরে টান মেরেছে একটামাত্র প্রশ্ন। “বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?” প্রশ্নটা ফেসবুকে লিখেছিলেন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক জিনিয়া। খুবই সহজ, সাধারণ ও মৌলিক প্রশ্ন। কিন্তু এটাই সহ্য হলো না ভিসি নাসিরের। হম্বিতম্বি করলেন, কুৎসিত আচরণ করলেন। আর সেটার রেকর্ডিং ফাঁস হওয়াতেই পড়লেন বিপাকে। ফুঁসে উঠলেন শিক্ষার্থীরা আর শেষমেষ পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন উপাচার্য। রাতের আঁধারে শিক্ষার্থীদের লুচ্চা লুচ্চা ধ্বনি শুনতে শুনতে একপ্রকার পালিয়েই গেলেন।

পরবর্তীতে বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ইত্যাদি ঘটনাগুলো পরপর দেখে মনে হচ্ছে জিনিয়ার সেই প্রশ্নটাই এখন সর্বত্র জোরেশোরে তোলা দরকার। “বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?” কেন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, পড়ায়? এর সঙ্গে মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্রের সংযোগ কোথায়, সম্পর্ক কী?

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রমরমা খুবই নিকট অতীতের ঘটনা। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে ছিল শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এবং মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে অধ্যাদেশ জারি করে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল। কারণ তখনকার স্পিরিট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা। নতুন বাংলাদেশ এমন বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিল যেখানে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা যাবে। স্বাধীনভাবে সভা, সমিতি, সেমিনার, সংগঠন ইত্যাদি করা যাবে। রাষ্ট্র বা সরকার সেখানে বাধা দিতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কোনো সিদ্ধান্তে তারা নাক গলাতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পুলিশ, র‌্যাব সেনাবাহিনী ঢুকবে না। নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব বিভাগ (প্রক্টরিয়াল বডি) থাকবে।

কারণ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্পিরিট এটাই ছিল যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজের কল্যাণে কাজ করবে, জনমানুষের মঙ্গলের উদ্দেশে কাজ করবে। সেই লক্ষ্যে নতুন জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করবে, সৃজন করবে। এবং নতুন কিছু সৃজনের জন্য চাই স্বাধীনতা। যদি চিন্তার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, মুক্ত বিচরণের অধিকার না থাকে তাহলে কিভাবে নতুন কিছু ভাবতে পারা যাবে? বোধহয় সম্ভবও না। তাই পাকিস্তানের কবল থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেওয়া হয়েছিল চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যৌথ চিন্তা-চর্চা অনুশীলনের জন্য সংগঠন করার স্বাধীনতা।

মনে রাখা দরকার এগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছে কিন্তু পাবলিক। শিক্ষকদের বেতন দিচ্ছে কিন্তু পাবলিক। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আরও তলিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, টাকাটা আসলে আসছে কৃষক-শ্রমিকদের শ্রম-ঘামে সিক্ত উৎপাদনশীল ক্ষেত্রগুলো থেকেই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কিন্তু এই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের কল্যাণে, সমাজের কল্যাণের স্বার্থে, অগ্রগতির স্বার্থে কাজ করার কথা এই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। এজন্যই তাদেরকে জ্ঞানচর্চার সুযোগ করে দেয় পাবলিক। যেন সমাজের মঙ্গলের জন্য তারা নতুন দিশা দিতে পারেন। নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারেন, নতুন কোনো আইডিয়ার কথা বলতে পারেন। এভাবেই হয়েছে মানবসভ্যতার অগ্রগতি। নতুন চিন্তা-চর্চার ফলে। এবং এই কাজগুলোই করার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। পাবলিক এগুলোই করার জন্য টাকা দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। বাবা-মা আমাদের ভরণপোষণ করে, আমাদের পড়ালেখা শেখায় এজন্য যেমন তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে; ঠিক একই রকম দায়বদ্ধ অনুভব করা উচিৎ পাবলিকের কাছেও।

পিটিয়ে শিক্ষার্থী মেরে ফেলা, টর্চার সেল বানিয়ে অসীম সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েদের মানসিকভাবে পঙ্গু বানিয়ে ফেলা, মেয়েদের যৌন নিপীড়ন, সর্বত্র প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক হয়রানি, উন্নয়নের নামে লুটপাট; এগুলো করার জন্য পাবলিক টাকা দেয় না। অথচ এগুলোই হয়ে চলেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আর সমাধান হিসেবে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্র-প্রশাসনের আরো স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার টোটকা। বন্ধ করে দিতে বলা হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সংগঠন করার অধিকার।

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলে, শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নিলে কী অবস্থা দাঁড়ায়, তা খুব প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৯ সালে শিবির বনাম ছাত্রলীগ+জাসদ+মৈত্রী ইত্যাদির সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দুই-আড়াই মাস পর ক্যাম্পাস খোলার পর প্রশাসন জারি করেছিল জরুরি অবস্থা। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ, কারোরই সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল; কিচ্ছু করা যাবে না। শিবির ঠেকানোর নাম করে জারি করা সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ আছে বলে জানি। এবং এই ১০ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে তা পত্রপত্রিকা মারফত সবাই কমবেশি অবগত আছেন।

২০০৫-০৬ সালের দিকে রাবিতে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল। মাঝেমধ্যেই এখানে ওখানে আয়োজিত হতো পথনাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এমনও হয়েছে যে একই দিনে একই সময়ে দুই-তিন জায়গায় পথনাটক হচ্ছে। অনেক ছোটবড় প্রকাশনা বের হতো। সেগুলো ঘিরে একধরনের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চিন্তা-চর্চার পরিবেশ ছিল। আড্ডা, পড়াশোনা, তর্কবিতর্ক, গান-নাটক দিয়ে মুখরিত থাকত রাবি ক্যাম্পাস।

এসবই কিন্তু হয়েছে শিবিরের প্রবল দাপুটে আমলে। রাবিতে শিবিরের মিছিল গেলে মিনিট দশেক ক্লাস থামিয়ে রাখতে হতো। এক মাথায় দাঁড়ালে আরেক মাথা দেখা যেত না। এরকম একটা আবহের মধ্যে রাবিতে প্রাণ ছিল ভরপুর। শিবিরের নিপীড়ন-নির্যাতনও অবশ্যই ছিল। বাম রাজনীতি, সাংস্কৃতিক সংগঠন বা ছোট-কাগজ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা হলে থাকতে পারতেন না। মারধর, হুমকিধামকির মুখে পড়তে হতো। হলগুলোতে শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, দখলদারিত্ব ইত্যাদি ছিলই।

কিন্তু নানাবিধ চিন্তা-চর্চার প্রাণবন্ত পরিবেশ সেই সময়টাতে ছিল। এটা নাই হতে শুরু করেছে ২০০৯ সালের সেই নিষেধাজ্ঞার পর থেকে। এই নিষেধাজ্ঞা কিন্তু আবার ছাত্রলীগের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে প্রক্টরের সঙ্গে হেঁটেছে। সেই সময়ের প্রক্টর, জাকারিয়া সাহেব এখন উপ-উপাচার্য হয়েছেন। যার টাকা চাওয়ার অডিও প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। অন্য সবার মুখ বন্ধ করে ছাত্রলীগকে দেওয়া হয়েছিল অবাধ স্বাধীনতা। এবং শিবির দমনের নামে যা নয় তা করেছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। মারধর করেছে, চাঁদাবাজি করেছে, “শিবির বলে ধরিয়ে দিব” এমন হুমকি দিয়ে হেনস্তা করেছে। সর্বশেষ বুয়েটে আবরারকেও কিন্তু শিবির মারছে বলেই মারা হয়েছে। ছাত্রলীগ-প্রশাসনের সেই মৈত্রী এখনো অটুট আছে।

সেসময় কোনো ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। গত ১০ বছরে এসব সংগঠন বিলুপ্ত, প্রায় বিলুপ্ত বা সুপ্ত অবস্থায় নামসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। ৪র্থ বর্ষ বা মাস্টার্সের কোনো শিক্ষার্থী বোধহয় ১-২টা পথনাটক বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছে কিনা, সন্দেহ আছে। ক্যাম্পাস থেকে প্রকাশিত কোনো পত্রপত্রিকা হাতে নিয়েছে কিনা, সন্দেহ আছে। অন্যান্য জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক চিন্তা-চর্চার কথা বাদই দিলাম। পড়ালেখা-গবেষণার পরিমাণ, সেগুলোর মান কোনোকিছুই ধর্তব্যের মধ্যে আনলাম না।

তো এই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তর। “মৌলবাদী” শিবিরের আমল থেকে “প্রগতিশীল-চেতনা-ধারী” আমলের রূপান্তর। প্রাণবন্ত প্রাণময় একটা দশা থেকে প্রাণহীন প্রাণীর দশায় রূপান্তর। আর এসব কিছুর মূলে ছিল ২০০৯ সালের সেই নিষেধাজ্ঞা এবং সেটা বিনা চ্যালেঞ্জে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত।

নিষেধাজ্ঞার রাজনীতিতে তাই ভরসা রাখা কঠিন। এমনিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো খুব দারুণ কিছু করছে- এমনটাও না। তাদের অনেক কিছু নিয়েই অনেক সমালোচনা আছে। কিন্তু সেটা এভাবে আদেশ জারি করে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার কিছু নেই। এতে বরং শঙ্কা বাড়ে, শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা-চর্চার পরিবেশ আরো সঙ্কুচিত হয়ে যাবে না তো? প্রশাসনিক ও একাডেমিক নিপীড়ন আরো বাড়বে না তো? শিক্ষার্থীরা কথা বলতে পারবে তো সরকার-প্রশাসনের গনবিরোধী, শিক্ষার্থীবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে? নিজেদের শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকবে তো?

এখানেই আসে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্তের প্রশ্ন। তারা যদি সংগঠিত হওয়ার নতুন পদ্ধতিপন্থা ভাবতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী এই প্রশ্ন সামনে এনে জনকল্যাণমুখী তৎপরতায় সামিল হতে পারেন; তাহলে সেটাই হবে আবরারের প্রতি সুবিচার। যে ছেলেটা প্রাণ দিল ন্যায্য কিছু কথা বলার জন্য, নিজের মতপ্রকাশের জন্য।

এই স্বাধীন পরিবেশটা কিন্তু সরকার-প্রশাসন এমনি এমনি দিয়ে দিবে না। শিক্ষার্থীদের সদা তৎপর থাকতে হবে সেটা নিশ্চিত করার জন্য। ঠিক যেভাবে তারা তৎপর হয়েছিলেন আবরার হত্যার প্রতিবাদে। সিসি টিভি ফুটেজ উদ্ধারের সময়; সেভাবে তৎপর থাকতে হবে। সবসময় চোখে চোখে রাখতে হবে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের। আর এসব করার জন্য চাই শিক্ষার্থীদের সংগঠিত শক্তি। সেখানেও নতুন করে ভাবতে পারে শিক্ষার্থীরা।

হলগুলোতে টর্চার সেল বন্ধ ও গেস্টরুম-গনরুম কালচার বন্ধ করার জন্য শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হতে পারে ব্লক ধরে ধরে। সবগুলো ব্লক নিয়ে গঠন করা যেতে পারে হল ফেডারেশন। যে ফেডারেশন কাজ করবে ব্লকগুলো থেকে আসা প্রতিনিধিদের সমন্বয়ের মাধ্যমে। এই প্রতিনিধিদেরও বিশেষ কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তারা স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারবে না। পুরো ব্লকের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। কোনো অনিয়ম চোখে পড়লে প্রতিনিধিকে রিকল করা যাবে। সভাপতি-সেক্রেটারিওয়ালা হায়ারার্কির চর্চা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হতে পারেন এমন আরো অনেক নতুন উপায়ে। যেখানে সবার মত প্রকাশের সমান অধিকার থাকবে। বড়ভাই বা নেতার কথার বিরুদ্ধে কথা বললে যেখানে তিরস্কার বা বহিষ্কারের মুখে পড়তে হবে না। সবার সমান মর্যাদা থাকবে।

শুধু বুয়েটই না, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই এভাবে প্রচলিত পচাগলা ছাত্র রাজনীতির বাইরে নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেন। শুধু হলেই না, বিভাগগুলোতেও শিক্ষার্থীদের আরো বেশি বেশি অংশগ্রহণের দাবি উঠাতে পারেন। শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু, বিভাগীয় সভায় শিক্ষার্থী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি, এ ধরনের আরো দাবি উঠাতে পারেন। এমন পরিবেশ তৈরির দাবি তুলতে পারেন যেখানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারী আচরণ করতে পারবে না এখনকার মতো। তাদেরও জবাবদিহিতার জায়গা থাকবে শিক্ষার্থীদের কাছে।

আবরারের হত্যাকাণ্ডকে যদি একটা নতুনের সূচনা হিসেবে ধরি, আবরারের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু শুরু করতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী পরিবর্তন চাই, তাহলে এমন অনেক দাবি-প্রশ্ন তুলতে হবে শিক্ষার্থীদের। জোরেশোরে তুলতে হবে সেই মোক্ষম প্রশ্ন: “বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?” যে জনগণর করের টাকায় এবং কৃষক-শ্রমিকের প্রত্যক্ষ অবদানের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে, শিক্ষকরা শিক্ষকতা করার সুযোগ পাচ্ছে তাদের কাজ কী আসলে?

একটা প্রধান কাজ জনকল্যানার্থে নতুন জ্ঞানের চিন্তা-চর্চা করা ও সৃজন করা। কিন্তু নতুন কোনো চিন্তা-চর্চার অনুশীলন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় হয়না বললেই চলে। মুক্তিযুদ্ধের পর ৭৩-এর অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়কে এতো স্বাধীনতা দেওয়ার পরেও তাহলে কেন বজায় থাকছে না সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্ত পরিবেশ? কারণ নামে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হলেও রাষ্ট্র-রাজনীতির শুঁড় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। সেজন্যই বারবার দেখা যায়, সরকার পরিবর্তন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রশাসন পরিবর্তন হয়ে যায়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সে দলের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসগুলোতে দাপট দেখায়। তাদের সন্ত্রাসের মুখে জিম্মি হয়ে থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিভাবে রাষ্ট্রের শুঁড় প্রবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে?

প্রবেশ করে উপাচার্য নিয়োগের মাধ্যমে। “বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাটিউট বা নীতি নির্ধারণের সর্বোচ্চ ফোরাম সিনেট। সিনেটরদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত তিন জনের প্যানেল থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্রপতির এ নিয়োগও হয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুসারে, তথাকথিত পরামর্শ নামে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মানেই দলীয় চূড়ান্ত ক্ষমতা। আর তাই উপাচার্য হতে গেলেও পার্টিজান হতে হবে। আর এ কারণেই দেখা যায়, রাষ্ট্র ক্ষমতায় পার্টি বদলালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য বদলে যান।” আবার “উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। বিশ্ববিদ্যালয়ে কি দৃশ্যমান, কি অদৃশ্যমান, সকল ক্ষমতার মালিক তিনি।”১ ফলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ই এই উপাচার্যের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে। এবং অন্যদিকে উপাচার্য রাষ্ট্র-সরকারের পদলেহন করতে থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এসব অন্যায্য ক্ষমতা-কর্তৃত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে হলে এসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, উপাচার্যের ক্ষমতা, রাষ্ট্র-বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলতে হবে। নতুন কাঠামো প্রণয়নের দাবি তুলতে হবে। সেই দীর্ঘমেয়াদী কাজগুলো ধীরে ধীরে শুরু হবে- এমনটাই প্রত্যাশা।

টর্চার সেলওয়ালা, প্রশাসনিক কারাগারওয়ালা, প্রাণহীন একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাতারাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার আদর্শ পরিবেশে পরিণত করা সম্ভব না। কিন্তু রূপান্তরের প্রক্রিয়াটা শুরু হোক। একটু একটু করে আরো নানা কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করুক শিক্ষার্থীরা। সংগঠিত হোক, চিন্তা-চর্চার শিখা প্রজ্বলিত রাখুক, মুক্তচিন্তা ও বিবেকের অধিকার সমুন্নত রাখুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *