প্রথম আলোয় ইরাকে মার্কিন হামলা: আগ্রাসন যখন মুনাফার মওকা

  • আ-আল মামুন

সম্পাদকীয় মন্তব্য: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আ-আল মামুন রচিত প্রথম আলোয় ইরাকে মার্কিন হামলা: আগ্রাসন যখন মুনাফার মওকা  শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে;যোগাযোগ, সংখ্যা ৬, ২০০৩। সম্প্রতি আমরা আফগানিস্তান, ওয়ার অন টেরর, তালেবান, মার্কিন ইত্যাদি নিয়ে নানান বাৎচিত খেয়াল করছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আ-আল মামুনের প্রায় ২০ বছর পূর্বের প্রবন্ধটি রাষ্ট্রচিন্তা ব্লগে পুনরায় প্রকাশিত হলো। প্রকাশের অনুমতি দেয়ার জন্য আমরা আ-আল মামুনের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সে সময়ে প্রকাশিত তার আরেকটি প্রবন্ধ, ‘মক্কেল রাষ্ট্রের একটি সংবাদপত্রে মার্কিন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’’, রাষ্ট্রচিন্তা ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রবন্ধের শিরোনামেই গুরুতর ‘আপত্তিকর’ অভিযোগ দাখিল করা হয়ে গেল। প্রথম আলোর মুগ্ধ পাঠকদের পক্ষে এই অভিযোগ মেনে নেওয়া পীড়াদায়ক- বিশেষত প্রথম আলোতে বিপুল কভারেজ দিয়ে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনকে তুলে ধরার কারণে এবং এই হামলাকে হামেশা নিন্দা জানানোর কারণে। প্রথম আলোতে কর্মরত সাংবাদিক ও পরিচালকমণ্ডলীর পক্ষেও, যারা দিনরাত অকাতর পরিশ্রম করে ইরাকে মার্কিন হামলাকে নানা রঙে শব্দে-ছবিতে তুলে ধরেছেন, এই অভিযোগ মেনে নেওয়া কঠিন। প্রবন্ধের লক্ষ্য এখানে, তারপরও, এই অভিযোগকেই প্রমাণ করা যে প্রথম আলোর বিপুল-আগ্রাসী কভারেজের উদ্দেশ্য ছিল ইরাকে মার্কিন হামলার ভয়াল চিত্র ঐতিহাসিক পরম্পরাসমেত বোধগম্য করে তোলার দিকে যতোটা না তার চেয়ে বেশি পত্রিকা ক্রেতার পকেটের দিকে।

দুইটি কারণে এরকম অনুসিদ্ধান্তে আসতে হয়। প্রথমত, বাংলার ঐ প্রবাদটা আমরা সবাই জানি যে ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’। প্রথম আলোতে এক কথায় কাভারেজ ছিল বিপুল। খোদ ইরাকের কোনো সংবাদপত্রে কিংবা আগ্রাসনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পত্রিকাতেও এতো বিপুল কভারেজ দিয়েছে কিনা সেব্যাপারে সন্দেহ আছে। সংবাদপত্রটির প্রথম পাতা, ভিতরে আক্রান্ত ইরাক নামে দুইটি কখনো কখনো তিনটি পাতা, অভিমত পাতার প্রায় পুরোটা এবং শেষের পাতার একটি অংশ ‘ইরাক যুদ্ধের’ জন্য বরাদ্দ করা হয়। সমর নায়করা যেমন যুদ্ধের বিস্তারের সাথে তাল রেখে নতুন নতুন ফ্রন্ট খোলেন তেমনই প্রথম আলোও ‘টেলিফোনে নাগরিক মন্তব্য’, সাময়িকীগুলোর-অন্য আলো, আলপিন, ছুটির দিনে, নারী মঞ্চ-এলাকায় ‘ইরাক যুদ্ধের’ বিস্তার ঘটায়। আর বিস্তার ঘটাতে গিয়ে বিভ্রান্তিও ছড়ায় বিপুল। সেকারণেই ঐরকম অনুসিদ্ধান্তে আসতে হয়। যুদ্ধের মাঝে উত্তেজনা আছে, বিস্ময় আছে, আছে মানবিক আবেদন। আর সাংবাদিকতার ভাষায় এই সবগুলোই ভাল ‘সেলিং এলিমেন্ট’। দ্বিতীয়ত, প্রচারণা বিশারদরা মোটাদাগে দুটো কৌশল অনুসরণ করে। যার একটা হলো পুরোপুরি তথ্য গোপন করে যাওয়া। অর্থাৎ, মিডিয়াতে বিষয়টিকে কোনো জায়গা না দিয়ে ‘কিল’ করে ফেলা। যেমন, ইরাকে দীর্ঘ ১২ বছরের অন্যায্য-বর্বর মার্কিনি অবরোধে ১৫ লক্ষাধিক মানুষের অনাহারে প্রাণহানী, নো ফ্লাই জোন করে নিয়মিত গুলিবর্ষণ, কুর্দিদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা, নোংরাভাবে সাদ্দামকে বহুবার হত্যা করার চেষ্টা আমাদের আধিপত্যশীল ধারার সংবাদপত্রগুলোতে হামলা শুরু হওয়ার আগে কখনোই আসেনি। প্রথম আলোতেও নয়। ফলে ইরাকে নীরবে যে নিয়মিত হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন চলছিল তা ছিল জনগণের একেবারেই জানার বাইরে। এই কৌশল যখন ব্যর্থ হয় কিংবা জনগণের কাছে যখন কিছু তথ্য ফাঁস হয়ে যায় তখন আরেকটি কৌশল অবলম্বন করা হয়। সেটি হলো, অতি বেশি পরিমাণে বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিস্তার ঘটানো। ফলে, জনগণের পক্ষে সঠিক চিত্রটি এঁকে ফেলা কঠিন হয়ে পড়ে, মূল জায়গা থেকে মনোযোগ সরে যায়। আমাদের সাংবাদিকতার মডেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই কৌশলের প্রয়োগ ঘটে বিপুল জনসংযোগ তৎপরতা, প্রেস-রিলিজ, প্রেস-ব্রিফিং এবং অযাচিতভাবে সাংবাকিদের কাছে নিজেদের তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে। প্রথম আলো প্রশ্নাতীতভাবে পশ্চিমা সূত্রের ওপর নিভর করে এই দ্বিতীয় কৌশলের বাহন হিসেবে কাজ করে। ফলে, তারা পাঠকের মনে বিশ্বাস জন্মায় ডব্লিউ বুশের মতো এক বেহেড লোকের পাল্লায় পড়েই বুঝি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ সকল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছে। নচেৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষেই কাজ করে। এই প্রথমবার এরকমটি ঘটলো। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই শতকের শুরু থেকেই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের যোগ্য উত্তরসূরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের জানা থাকা দরকার, “এযাবতকালের ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যে-দেশ একই সাথে বিশ্ব আদালত কর্তৃক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের দায়ে নিন্দিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত প্রস্তাবের প্রতি ভেটো প্রদান করেছে।” (নোম চমস্কি, ‘সন্ত্রাসবাদ কাজে লাগে’, অনুবাদ: উদিসা ইসলাম, মানুষ সন্ত্রাস-মিডিয়া-যুদ্ধ সংখ্যা: ২০০৩, পৃ, ১৩৯)।

২০শে মার্চ ২০০৩ তারিখে গুরু-সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাজ্যকে সাথে নিয়ে শক্তিশালী চ্যালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা শুরু করে এবং ৯ই এপ্রিল ২০০৩ তারিখে বাগদাদ ‘হানাদার বাহিনীর’ দখলে চলে যায়। এই পুরো সময়ের ঘটনা-প্রবাহ প্রথম আলো নানা সূত্র মারফত হাজির করেছে। এজন্য, ২১শে মার্চ থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম আলোর প্রতিটি সংখ্যা এই প্রবন্ধ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রেক্ষাপট: ‘আক্রান্ত আমেরিকা’ থেকে ‘আক্রান্ত ইরাক’

যুক্তরাষ্ট্রের ‘টুইন টাওয়ারে’ সন্ত্রাসী হামলার অজুহাতে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার উৎখাতের ঘটনা এবং ব্যাপকবিধ্বংসী অস্ত্র ও অন্যান্য ছুতোয় সাদ্দাম সরকারকে উৎখাতের জন্য ইরাকে হামলা প্রায় বছরখানেকের ব্যবধানে ঘটে। দুটোই উলঙ্গ আগ্রাসনের ঘটনা। আফগানিস্তানের হামলার প্রতি প্রথম আলোর সমর্থন ছিল নিরঙ্কুশ। প্রথম আলো ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে সম্পাদকীয় রচনা করে “আক্রান্ত আমেরিকা”। যুক্তরাষ্ট্রে এই হামলাকে সভ্যতাবিরোধী, কাপুরুষোচিত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। “সন্ত্রাসীরা যে অমানবিক, সভ্যতা বিধ্বংসী জঘন্য অপরাধ করেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। ধিক্কার জানাই এই কাপুরুষোচিত হামলার”। আরও বলা হয়, “ওরা সভ্যতার পথের কাঁটা। ওদের ক্ষমা নেই”। শুধু সমর্থনই দেয় না। নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার যথার্থ কারণ অনুসন্ধান না করে বরং ‘অন্ধ গোঁড়া’ তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিনি আগ্রাসনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করে। আফগানিস্তানে একটি ‘হামিদ করজায়ী তাঁবেদার সরকার’ প্রতিষ্ঠা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে প্রথম আলো যে-কভারেজ দিয়েছিল তা আমি বিশ্লেষণ করেছিলাম। মক্কেল রাষ্ট্রের একটি সংবাদপত্রে মার্কিন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শিরোনামে সেটি প্রবন্ধাকারে মানুষ পত্রিকার সন্ত্রাস-মিডিয়া-যুদ্ধ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। উপসংহার টেনেছিলাম, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা ও সেই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে’ প্রথম আলো যেভাবে তুলে ধরে তা বিচার করে আমরা বলতেই পারি যে ক্ষমতা ও সম্পদের দিক থেকে প্রান্তিক এই দেশের আধিপত্যশীল ধারার একটি মিডিয়া পশ্চিমমুখো নির্ভরতায় কর্পোরেট-অর্থনীতির শীর্ষস্থানীয়দের স্বার্থকেই রক্ষা করে চলে।”

আফগানিস্তানে মার্কিনি হামলা নিয়ে প্রথম আলোর অভিমত পাতায় যে-লেখাগুলো ছাপা হয়েছিল তার সবগুলোতেই ভগ্নোদ্যত টুইন টাওয়ারের ছবির ওপর ‘আক্রান্ত আমেরিকা’ লেখাকে লোগো হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর এইবার ইরাকে মার্কিন হামলাকে কাভারেজ দিতে গিয়ে অভিমত পাতার সকল লেখার শুরুতে লোগো হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘আক্রান্ত ইরাক’ শব্দবন্ধ। কেবল এটুকুই নয়। ২৪শে মার্চ ২০০৩ তারিখ থেকে ‘সারা বিশ্ব’ পাতার নামই বদলে ফেলা হয়। পাতাটির নাম হয় ‘আক্রান্ত ইরাক’। ভেতরের দুটো, কখনো কখনো তিনটি, ‘আক্রান্ত ইরাক’ নামের পাতা বরাদ্দ করা হয় এই আগ্রাসন প্রতিফলিত করতে। এই বিপুল কাভারেজ নিয়ে প্রথম আলোর আত্মগরিমাও আছে। ‘এ যুদ্ধ মানবতার বিরুদ্ধে’ শিরোনামে ২৪শে মার্চ নাগরিক মন্তব্য প্রথমবারের মতো ছাপা হয়। মতিঝিলের একজন ব্যবসায়ীর মন্তব্য সবার আগে উদ্ধৃত করা হয়। তিনি যুদ্ধকে অন্যায় আখ্যায়িত করার পাশাপাশি বলেন, “প্রথম আলো যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করছে তার জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।”

সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে দৃশ্যত প্রথম আলো ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ২১শে মার্চ প্রথম আলোর প্রধান সংবাদ-কাহিনী বাগদাদে হামলা, টার্গেট সাদ্দাম-এ বলা হয়, “জাতিসংঘের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে, পোপ এবং বহু রাষ্ট্রসহ বিশ্বজনমতের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে, পশ্চিমা মিত্রদেরও বিভক্তির মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করেছে।…এভাবেই শুরু হল ইতিহাসের সবচেয়ে অনাকাক্সিক্ষত এক বর্বর যুদ্ধ।” সেদিনই তারা সম্পাদকীয় রচনা করে, যার শিরোনাম, ‘ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ হামলা: বুশকে ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকতে হবে’।

কিন্তু, প্রথম আলোর এই ঘোষিত অবস্থানের মধ্যে স্ববিরোধিতা আছে। শতবছরব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা তারা পাঠকের বোধগম্য করে তুলতে চায় না। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা, যা আগ্রাসী হামলাকে অনিবার্য করে তোলে, চ্যালেঞ্জ করে না। বরং অন্য বাসনা তারা এই হামলার সুযোগে চরিতার্থ করে- মুখ মে শেখ ফরিদ বগল মে ইট। প্রথম আলোর এই চরিত্র বোঝার জন্য নোম চমস্কি এবং এডোয়ার্ড এস. হারম্যানের ম্যানুফ্যাক্চারিং কনসেন্ট গ্রন্থ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের মিডিয়ার স্বভাব বিচার করে তারা বলেছিলেন: “যেসব দেশে ক্ষমতার কেন্দ্র রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত সেসব দেশে মিডিয়ার ওপর আরোপিত একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, এবং সচরাচর এর সাথে যুক্ত সরকারি সেন্সরশিপ, স্পষ্ট করে তোলে যে সেখানকার মিডিয়া প্রভাবশালী অভিজাতদের স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু মিডিয়া যেদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং আনুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ অনুপস্থিত সেখানে তৎপর প্রচারণা সিস্টেমের কার্যক্রম শনাক্ত করা অনেক বেশি দুরূহ। আর এই দুরূহতা আরও বেড়ে ওঠে যখন দেখা যায় মিডিয়াগুলো প্রতিযোগিতায় সক্রিয়, কখনো কখনো কর্পোরেট ও সরকারের অপতৎপরতা উন্মোচন করে, আক্রমণ করে এবং উগ্রভাবে নিজেদেরকে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও গণমানুষের স্বার্থের মুখপত্র হিসেবে চিত্রিত করে” (ভিনটেজ, ১৯৯৪: ১)।

চমস্কি-হারম্যানের কথামাফিক আমরা দেখি, প্রথম আলোর অভিমত পাতায় মার্কিন হামলাবিরোধী অসংখ্য লেখা ছাপা হয়; ইরাকে ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার যে ছবিগুলো এমনকি মার্কিন মূলধারার পত্রিকাতেও দেখা যায় না সেগুলো উঠে আসে; সম্পাদকীয়তে এই হামলাকে অন্যায়, অযৌক্তিক, মানবতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং অনেকগুলো সংবাদ-কাহিনী এই হামলার বিভীষিকা তুলে ধরে। ফলে, প্রথম আলোর ‘অন্য অভিলাষ’ শনাক্ত করা দুরূহ হয়ে ওঠে। এখন সেই দুরূহ কাজটি করার চেষ্টা করি।

সাদ্দামকে ভাষণ দেওয়ার সময় ক্লান্ত দেখাচ্ছিল

মার্কিন হামলা শুরুর পরের দিনই অর্থাৎ ২১শে মার্চ সাদ্দাম হোসেন এবং ডব্লিউ বুশের জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ ছাপা হয় প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। এখানে একটা কথা বলে নিই, কী ঘটনা ঘটেছে সেটা যেমন বাস্তবতা তৈরি করে তেমনই সংবাদপ্রত্রের পাতায় ঐ ঘটনাটা কীভাবে উপস্থাপন করা হলো, কতোটুকু উপস্থাপন করা হলো তাও একধরনের স্বাধীন বাস্তবতা নির্মাণ করে, যে-নির্মাণ কোনোভাবেই কম শক্তিশালী নয়। সাদ্দামের ভাষণের শিরোনাম, “সাদ্দামের ভাষণে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান: ইনশাআল্লা জয় আমাদের নিশ্চিত”। আর বুশের ভাষণের শিরোনাম, “বুশের ভাষণে সাদ্দামকে উৎখাতের প্রতিশ্রুতি: যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী ও কঠিন হবে”

শিরোনাম দুটো লক্ষণীয়। অন্যায় আগ্রাসনকারী মার্কিন সরকারপ্রধান বুশ সাদ্দামকে উৎখাতের ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছেন। কার স্বার্থে সাদ্দামকে উৎখাতের প্রতিশ্রুতি? কে তাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার অধিকার দিল? দখলদার প্রতিশ্রুতি দেয় নাকি হুমকি দেয়। শিরোনাম হতে পারতো ‘বুশের ভাষণে সাদ্দামকে উৎখাতের হুমকি/ঘোষণা’। কিন্তু প্রথম আলো ‘প্রতিশ্রুতি’ শব্দটা বেছে নেয়। ফলে অন্যায় হামলা গ্রহণযোগ্যতা পায়, যা প্রথম আলোর ঘোষিত আগ্রাসনবিরোধী অবস্থানের সাথে বৈপরীত্য তৈরি করে। সাদ্দামের ভাষণের শিরোনামটাও দেখুন। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘ইনশাআল্লা জয় আমাদের নিশ্চিত’। শুধু ‘জয় আমাদের নিশ্চিত’ বললেও কিন্তু চলতো। ‘ইনশাআল্লা’ মূল্যআরোপক শব্দ। পশ্চিমা প্রচারণায় স্বতঃসিদ্ধভাবে মুসলমান মানেই ‘দাড়ি-টুপি-মৌলবাদ’। এবং এই ইমেজকে সবসময় জাগিয়ে রাখা হয়। ফলে সাদ্দামের ভাষণের শিরোনাম দিতে অযাচিতভাবে ‘ইনশাআল্লা’ শব্দটি ঠাঁই করে নেয়। বুশের ভাষণে এরূপ কোনো ধর্মীয় শব্দ থাকে না।

আমরা টেক্সট ধরে এগিয়ে যাই। সাদ্দামের ভাষণের একজায়গায় বলা হচ্ছে, “পুত্র উদের ইয়ুথ টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণটি সরাসরি না আগে রেকর্ডকৃত সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।” বুশ কোন্ টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছিলেন? সেকি মার্কিন সরকারের মাউথপিস সিএনএন-এ, নাকি সাম্রাজ্যবাদী হামলার সহায়ক অন্য কোনো চ্যানেলে? বুশের ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে নাকি আগেই রেকর্ড করা ছিল? এরকম মূল্যায়নমূলক তথ্যগুলো কিন্তু বুশের ভাষণের বেলায় পাঠককে জানানো হয় না। সাদ্দামের ভাষণের বেলায় বলা হচ্ছে, “সাদ্দামকে ভাষণ দেওয়ার সময় ক্লান্ত দেখালেও স্বভাবগতভাবেই তিনি জোরালো কণ্ঠে বক্তব্য রাখেন”। বুশকে ভাষণ দেবার সময় ক্লান্ত দেখাচ্ছিল নাকি উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল তাও কিন্তু বলা হয় না। আরও বলা হয়, “লিখিত এই ভাষণের শুরুর দিকে সাদ্দাম বলেন…”। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বুশও লিখিত ভাষণ পাঠ করেছিলেন। কিন্তু সেটা বলা হয় না। সাদ্দামের ভাষণে কোরআন থেকে উদ্ধৃতি, আরবি কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার কথা পাঠককে জানানো হয়। অর্থাৎ, সাদ্দামের ভাষণের রিপোর্টে যে-বিষয়গুলো উঠে আসে তা প্রাচ্যবাদী স্কিমের ধারণাগুলোকে আরও দৃঢ়বদ্ধ করে।

অন্যদিকে, বুশের ভাষণের যে-বিষয়গুলো রিপোর্ট আকারে উঠে আসে তা যুক্তিপূর্ণ, নিরাবেগ এবং সার্বিকভাবে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি জানার বিষয় যেন। যেমন বলা হচ্ছে, “মার্কিন সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্যে বুশ বলেন, মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর যেসব পুরুষ ও মহিলা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছেন, বর্তমানে আপনাদের ওপর নির্ভর করছে সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বের শান্তি ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তি”। আবার বলা হচ্ছে, “মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র এমন এক শত্রুর মোকাবিলা করছে, যার যুদ্ধের রীতিনীতি ও নৈতিকতার প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। সাদ্দাম হোসেন বেসামরিক এলাকায় সৈন্য ও যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন করে তার সেনাবাহিনীকে রক্ষা করার জন্য নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদেরকে বর্ম হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে, যা জনগণের প্রতি তার চূড়ান্ত বর্বরতা।”

বুশের যে-কথাগুলো উদ্ধৃত করা হলো তা ডাঁহা মিথ্যে। কিন্তু এই রিপোর্টে জনাব বুশকে এরকম আরও অনেক মিথ্যাচার করার সুযোগ করে দেয়া হয়। তদুপরি, অন্যায় আগ্রাসনের শিকার সাদ্দামের ১০ মিনিটের ভাষণের জন্য প্রথম আলোতে যে-পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে তার তুলনায় আগ্রাসনকারী বুশের ৪ মিনিটের ভাষণের জন্য অধিক জায়গা বরাদ্দ করা হয়।

৩০শে মার্চে প্রকাশিত বুশের রেডিও ভাষণটি দেখুন, যার শিরোনাম: যুদ্ধ কতদিন চলবে জানি না, তবে ফল আমাদের জানা। বলা হচ্ছে, “বেতার ভাষণে বুশ ইরাকি সেনা কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে সতর্কতা উচ্চারণ করেন। তিনি সাদ্দামেরও তীব্র সমালোচনা করে বলেন, যুদ্ধবন্দিদের হত্যা করা হচ্ছে। আত্মসমর্পণের ভণিতা করে গুলি চালাচ্ছে সৈন্যরা। হাত নাড়িয়ে মার্কিন বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য এক ইরাকি মহিলাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে”। রিপোর্টিংয়ের ধরন দেখে মনে হয় বুশ যা বলেন, সত্য বলেন বলে তারা ধরে নেয়। যাচাই করার প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু বুশের এই অভিযোগগুলো কতোটা গ্রহণযোগ্য তা ইরাকি কর্তৃপক্ষ দ্বারা যাচাই করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। 

২২শে মার্চের প্রথম আলোর প্রথম পাতার মার্কিন হামলা থেকে সাদ্দাম ও তার পরিবার অক্ষত আছে শিরোনামের খবরটির শেষ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, “এদিকে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, গত বৃহস্পতিবার হামলা শুরুর পরপরই ইরাকি টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণটি ‘আসল সাদ্দাম’ দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তবে ভাষণটি আগেই রেকর্ড করা হতে পারে।” ঊর্ধ্বকমার মধ্যে ‘আসল সাদ্দাম’ লক্ষ করুন। সাদ্দাম প্রসঙ্গে ইরাকের কাউকে উদ্ধৃত না-করে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মার্কিন কর্মকর্তাকে। নিরপেক্ষ রিপোর্ট হলে মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘আসল সাদ্দাম’ শনাক্ত করা হতো না। রিপোর্টার বাগদাদে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতেন এবং রিপোর্ট করতেন। প্রচারণার মাধ্যমে পাঠকের মনে আসল নকলের এই দ্বন্দ্ব তৈরি করার চতুর মার্কিনি কৌশলের কাছে প্রথম আলো সহজেই ধরা দেয়।  

সভ্যতা ও অসভ্যতার সংঘাত

“আমেরিকা একটি সভ্য দেশ, অতি উন্নত দেশ। কিন্তু বুশ প্রশাসন ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সারা পৃথিবীর কাছে আমেরিকানদের শত্রু বানিয়ে দিল।” ২৩শে মার্চের প্রথম আলোর প্রথম পাতায় বুশ-ব্লেয়ার প্রশাসন কি উন্মাদ হয়ে গেল? শিরোনামের সংবাদ-বিশ্লেষণে মুসলেহ উদ্দীন এই কথাগুলো বলছেন। যথেষ্ট ইতিহাসজ্ঞান থাকলে মুসলেহ উদ্দীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘সভ্য’, ‘উন্নত’ শব্দগুলো প্রয়োগের বেলায় সতর্ক হতেন। কোন্ মানদণ্ডে তিনি এমন রায় দেন? স্থানীয় বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানদের সমূলে ধ্বংস করার মাধ্যমে সাদা চামড়ার মানুষদের কলোনি একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। যে-দেশটি আবার গত একশত বছর ধরে সারা পৃথিবীতে নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে; যে-দেশটির আগ্রাসী তৎপরতা শুরু হয়েছিল পার্শ্ববর্তী মেক্সিকো গ্রাস করার মাধ্যমে। যে দেশের নেতারা ভিয়েতনামে, নিকারাগুয়ায়, ফিলিপাইনে, এল সালভাদরে এবং এরকম অসংখ্য দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। পৃথিবীর একমাত্র জাতিবিদ্বেষী দেশ ইসরাইলকে সকলরকমের সহায়তা দিচ্ছে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাতে। যে-দেশের নেতারা হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল শুধু পৃথিবীবাসীকে পেশীশক্তি দেখানোর জন্য। তিনি আরও বলছেন, “১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা সারা দুনিয়াকে দুঃখ দিয়েছিল এবং এজন্য সারা দুনিয়া আমেরিকানদের সাথে হাত মিলিয়ে সন্ত্রাস দমনে নেমেছিল।” তিনি জানেন না কিংবা জানলেও পাঠককে জানাতে চান না যে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ প্রধান মদদদাতা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর ‘সন্ত্রাস দমনের’ নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে যে-আফগানিস্তানে কার্পেট বম্বিং চালিয়ে দেশটিকে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে-দেশে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। ড্যানি শেকটার বলছেন, “বুশ-প্রশাসন আফগান যুদ্ধেও তাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে ধরে নিয়েছেন। আর অধিকাংশ মিডিয়াও এই সুরে গলা মিলিয়েছে। কিন্তু ওসামা বিন লাদের বা মোল্লা ওমরের খোঁজ তারা কখনোই পায়নি। সন্ত্রাসীরা এখনও আফগানিস্তানেই রয়েছে।” (ড্যানি শেকটার, ‘Bush and his Press Corps Celebrate Victory’: http://www.gvnews.net/html/Crisis/gvalert141html.) 

৩১শে মার্চের প্রথম আলোর অভিমত পাতায় এ যুদ্ধের কোনো ইতিবাচক দিক নেই- কলামটি দেখুন। লেখাটিতে ফরিদুর রেজা সাগর বলছেন, “যুদ্ধ যারা শুরু করেছে, যুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে বা এই যুদ্ধের পরিকল্পনা যারা করেছে, তাদের মধ্যে নিশ্চয় প্রথম দিকে নাম আসবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের। আমাদের মতো তাবৎ মানুষের চেয়ে অনেক উপরের স্তরের মানুষ, বুদ্ধি তাদের বেশি, নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে যোগ্যতাও তাদের বেশি। সুতরাং তারা তাদের বুদ্ধি মেধা দিয়ে নিশ্চয়ই এমন কোনো কিছু আবিষ্কার করেছেন, যার কোনো ইতিবাচক দিক এই যুদ্ধের ভেতরে নিহিত রয়েছে।” কী অদ্ভুৎ যুক্তিশৃঙ্খল! তিনি প্রথমে অসংখ্য গুণবাচক প্রত্যয় যোগ করেছেন বুশ-ব্লেয়ারের নামের সাথে তারপর সেই জোরে যুদ্ধের মধ্যে ইতিবাচকতা আবিষ্কার করছেন! কোন্ স্বার্থে বুশ-ব্লেয়ার আগ্রাসী-অমানবিক-অন্যায় হামলা শুরু করেছেন সেটা তিনি বিচারেই নিলেন না।

প্রথম আলো ইরাকে হামলাকে অন্যায় বলছে, বর্বর বলছে, যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান করছে, বলছে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকতে হবে’। যেমন ২২শে মার্চ ইরাক যুদ্ধ ও জাতিসংঘ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে, “পারমাণবিক অস্ত্রধারী একক পরাশক্তির এই দস্যুবৃত্তির কাছে আধুনিক বিশ্বের নীতি-নৈতিকতা আজ ধুলায় লুণ্ঠিত। এ যুদ্ধ শুধু ইরাকের বিরুদ্ধে নয়, বিশ্বের শান্তিকামী জাতিসমূহের সৎ, স্বাভাবিক ও সুস্থ চিন্তার বিরুদ্ধেও এক অভাবনীয় আক্রমণ।” এই আক্রমণের সুরাহা কীভাবে হবে? প্রথম আলো পরামর্শ দিচ্ছে, “তাই আজ একটাই পথ খোলা। যুক্তরাষ্ট্রকে হাত গুটাতে হবে। মিসাইল আর বোমারু বিমানগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। এটাই সভ্যতার কথা।” এর চেয়ে বেশিদূর তারা আগায় না, ইতিহাস অনুসন্ধান করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বীভৎস সাম্রাজ্যবাদী চেহারা তারা উন্মোচন করে না। কোনো সম্পাদকীয়তেই গত বারবছরে অন্যায় মার্কিন অবরোধে ইরাকে ১৫ লক্ষ মানুষ নিহত হবার কথা উঠে আসে না। তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় না। কিংবা, বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে ইরাকে হামলার সম্পর্ক কী, অন্যান্য দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালায় কিনা, সেই হামলাগুলোর সাথে ইরাকে হামলার সম্পর্ক কী, ঐতিহাসিকভাবে বৈশ্বিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কী কলাকৌশল ব্যবহার করে তা নিয়ে আলোচনা করা হয় না কোনো সম্পাদকীয়তে। সুতরাং, ইরাকে মার্কিন হামলাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাঠকের মনে হয়। ফলে, এই হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করলেও পাঠকের মনে ‘সভ্য’ ‘উন্নত’ ‘গণতান্ত্রিক’ যুক্তরাষ্ট্রের মিথ টিকে থাকে।

অন্যদিকে, ইরাকের নেতিবাচকতার মিথও টিকিয়ে রাখা হয়। এই টিকিয়ে রাখার কাজে বিশেষত সহায়তা করে পশ্চিমা সূত্রের বরাতে ছাপা রিপোর্টগুলো। ২৩শে মার্চ সারা বিশ্ব (পৃ-৭) পাতায় সাদ্দাম হোসেনের উত্থান কাহিনী ছাপা হয়। পুরো সংবাদ-কাহিনীতে সাদ্দামের বর্বরতার খতিয়ান দিয়ে এক ভয়ানক চিত্র অঙ্কন করা হয়। এক জায়গায় বলা হয়, “নিজ ক্ষমতা সম্পর্কে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের যতো দম্ভই থাকুক না কেন, একথা তিনি নিশ্চিত হয়েই জানতেন যে দেশের সাধারণ লোক তাকে পছন্দ করে না। সাদ্দাম হোসেন সবসময়ই তার নিষ্করুণ রূপটিই ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন।” ইরাকে যে হামলা শুরু হয় তার পক্ষে সমর্থন তৈরি করতে হামলা চলাকালে এধরনের রিপোর্ট খুব সহায়তা করে। কিন্তু আগ্রাসনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক উত্থানকাহিনী তুলে ধরা হয় না। এমনকি ‘ভোট কারচুপির মাধ্যমে বুশের উত্থানকাহিনী’ জাতীয় কোনো সংবাদকাহিনীও ছাপা হয় না। এই একই দিনে ইইউ সম্মেলনে ব্লেয়ার ও শিরাকের মৃদু বাহাস শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপা হয়। এক ব্রিটিশ মন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, “আমরা দেখেছি ইউরোপ ও আমেরিকা পৃথক হয়ে পড়েছে। এই দূরত্বের ফলেই সাদ্দাম জাতিসংঘের ঘোষণা অমান্য করার সাহস পেয়েছে।” কিন্তু সত্য হলো, গত দশ বছরে ইরাক কেবল একবারই জাতিসংঘের আদেশ অমান্য করেছিল। তবু সেই অমান্য করার ঘটনা ঘটেছিল জাতিসংঘ অস্ত্রপরিদর্শক দলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা ঢুকিয়ে দিয়ে ইরাক থেকে তথ্য পাচার করলে পরে। আর হামলা শুরু হবার আগে ইরাক অস্ত্রপরিদর্শক দলকে সম্পূর্ণভাবে সহায়তা করছিল। কিন্তু তবু প্রথম আলো এই মিথ্যাচার ছাপে, যা ইরাক সম্পর্কে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করে। জাতিসংঘের নির্দেশ সবচেয়ে বেশিবার অমান্য করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইসরাইল। সে-সম্পর্কে তথ্য কোনো রিপোর্টে উঠে আসেনি।

২৩শে মার্চ ভারতীয় সাংবাদিক কুলদিপ নায়ারের একটি কলাম ছাপা হয় যুদ্ধের জন্য মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র শিরোনামে। তিনি বলছেন, “সাদ্দামের ব্যাপারে মোহ থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না। … সাদ্দাম নিজেও ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকবেন বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং বুশ ও ব্লেয়ারকে দায়িত্বহীন পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য।” সাদ্দামের ব্যাপারে মোহ থাকা বা না থাকার প্রশ্ন নয়, এখানে তিনি প্রকারান্তরে বুশ-ব্লেয়ারের হামলা শুরু করার দায় চাপাচ্ছেন সাদ্দামের ওপর। এটা সবারই জানা যে সাদ্দাম কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেননি। কিন্তু সাদ্দামকে সে দায়েও তিনি অভিযুক্ত করছেন। এরপরই তিনি বলছেন, “মুসলমানদের সংশ্লিষ্ট যেকোনো সমস্যাকে ধর্মীয়ভাবে বিবেচনা করার প্রবণতা কিছু মুসলিম নেতার রয়েছে।” কুলদিপ নায়ারকে প্রশ্ন করা দরকার, হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়, ইহুদপন্থী ইসরাইলী বা খৃস্টপন্থী মার্কিনি কিছু নেতার মধ্যে কি এমন প্রবণতা নেই? অবশ্যই আছে, সব ধর্মেই আছে। কিন্তু সেগুলোর উল্লেখ না করে তিনি কেবল মুসলমানদের ইজ্জতে আঘাত করেই আনন্দ পান। আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার সময় আমরা দেখেছি তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি খুব একটা খুশি নন। ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে প্রথম আলোরই অভিমত পাতায় প্রকাশিত এক লেখার তিনি বলেছিলেন, “নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি কিংবা কয়েকটি গ্রুপ নয় পুরো সম্প্রদায়কে (মুসলমান) এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, যে-কয়েকজন গোঁড়া লোক তাদের পুরো সম্প্রদায়কে আজ ছিনতাই করতে উদ্যত হয়েছে সেখানে তাদের কোনো প্রশ্রয় নেই”। মুসলমানদের মধ্যে কেন এমন ‘গোঁড়া মৌলবাদীদের’ প্রাদুর্ভাব হলো সে প্রশ্ন একবারও উত্থাপন না করে তিনি পুরো মুসলমান সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করে বসেন। শুধু তাই নয়। মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করে কুলদিপ নায়ার তার লেখায় প্রস্তাব করেছিলেন, “দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ওয়াশিংটন। ঘোষণাটি ১০০ ভাগ সমর্থনযোগ্য…। সারা বিশ্বকে এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিকল্পিত উপায়ে এ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়তে হবে।” কুলদিপ নায়ার সমর্থিত ওয়াশিংটন কীভাবে ‘সন্ত্রাস দমনে’ নেমেছিল সেখবর আমাদের সকলেরই জানা। ২৯শে মার্চ অভিতম পাতায় এ্যমনেস্টি ইন্টারন্যশনালের সেক্রেটারি (কলিম খানের ভাষায় শব্দটির অর্থ, যিনি সিক্রেট করেন, অর্থ্যাৎ আধিপত্যকারীদের দোষ গোপন করেন!) জেনারেল আইরিন খান যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানবতার প্রতিরোধ শিরোনামের কলামে বলেন, “যুদ্ধ আইনটি স্পষ্ট। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, তাদের মিত্রশক্তি এবং ইরাকের নেতৃবৃন্দ ও সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা সমানভাবে এই যুদ্ধের জন্য দায়ী।” ইরাকে হামলার জন্য সকলের দায় সমান- এমন বক্তব্য কে বিশ্বাস করবে? প্রথম আলো কেন এই ধরনের বক্তব্য ছাপে? তারা যদি মনে করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার জন্য দায়ী তাহলে এই ধরনের বক্তব্য একটা বৈপরীত্য তৈরি করে। ফলে, আমাদেরকে যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে ইরাকে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধ অবস্থান প্রথম আলো নেয়নি। আইরিক খানের  যে-ইমেজ তা পাঠকের কাছে বিক্রয় করার জন্য খুবই উপাদেয়। সুতরাং, প্রথম আলো কোনোরকম বিচার বিবেচনা ছাড়াই এধরনের স্টোরি ছেপে দেয়, যা প্রকারান্তরে মার্কিন প্রচারণাকে সহায়তা করে। 

২৪শে অক্টোবর প্রথম আলোয় ‘আক্রান্ত ইরাক’ পাতায় ইরাকি কুর্দিদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন শিরোনামের খবরে বলা হয়, “আশির দশকের শেষের দিকে সাদ্দাম কুর্দিদের ওপর আক্রমণ করে। এতে হাজারও কুর্দি নিহত বা বাস্তুচ্যুত হয়। ১৯৮৮ সালে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে নারী ও শিশুসহ ৫ হাজার কুর্দি মেরে ফেলা হয়। কুর্দিদের ভাষায় ‘এটা ছিল আমাদের হিরোশিমা’।” ইতহাসজ্ঞান যাদের আছে তারা জানেন, সারা বিশ্ব এই হামলার বিরুদ্ধে সেসময় সোচ্চার হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন সাদ্দামকে সমর্থন করেছিল এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছিল। মার্কিন সমর্থনে মার্কিন অস্ত্রই কুর্দিদের ওপর প্রয়োগ করেছিলেন সাদ্দাম। কিন্তু এই তথ্যগুলো রিপোর্টটিতে তুলে ধরা হয় না। কারণ তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শয়তানী ইমেজ ফাঁস হয়ে যায়। ২৯শে মার্চ ইরাকিদের কৌশল দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে শিরোনামের খবরে বলা হয়, “গত বৃহস্পতিবার ইরাকের ফরোয়ার্ড অপারেটিং সেলে বসে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভি-কোরের কমান্ডার ওয়ালেস বলেন, … অদ্ভুতুড়ে হামলার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে ইরাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমাদের ট্যাঙ্ক ও ব্রাডলি যুদ্ধযানের ওপর। মানুষ এতটা ভয়ঙ্কর দুধর্ষ হতে পারে ভাবতে কষ্ট হয়। লে. জেনারেল ওয়ালেস আরও বলেন, আমাদের সৈন্যদের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য ইরাকিরা তেতে আছে। তিনি অভিযোগ করেন, সাদ্দাম হোসেনের অনুগতরা পরিবার পরিজনদের ভয় দেখিয়ে সাধারণ ইরাকিদের যোদ্ধার খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য করছেন।” নিরপেক্ষ রিপোর্ট হলে ওয়ালেসের এই অভিযোগ সত্য কিনা তা যাচাই করার জন্য ইরাকি সাধারণ মানুষের সাথে এব্যাপারে কথা বলা হতো। কিন্তু যেহেতু এই ভাষ্যটাকেই পশ্চিমা প্রচারণা ব্যবস্থা বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করাতে চায় সেহেতু ইরাকি সূত্র দিয়ে এই দাবিকে প্রতিরুদ্ধ করা হয় না। স্বদশকে মার্কিন আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে চেষ্টাকারী ইরাকিদেরকে ওয়ালেস ‘ভয়ঙ্কর দুধর্ষ’ বলছেন। কিন্তু প্রায় নিরস্ত্র একটি জনগোষ্ঠীর ওপর সর্বাপেক্ষা অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্র নিয়ে যে মার্কিন বাহিনী হামলা চালাচ্ছে তাদেরকে এরকম বলা হয় না। বরং ভিন্নভাবে চিত্রায়িত করা হয়।  

সাদ্দামের গোপন অস্ত্র যত শিরোনামের খবরটি ছাপা হয়েছে ২৭শে অক্টোবর ‘আক্রান্ত ইরাক’ (পৃ-৫) পাতায়। অস্ত্র পরিদর্শক দল নিশ্চিত করেছে যে ইরাকের হাতে কোনো রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্র নেই। কিন্তু প্রথম আলোর এই রিপোর্টটিতে বলা হয়, “ইঙ্গ-মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মূল অস্ত্র রাসায়নিক, জীবাণু কিংবা এলিট রিপাবলিকান গার্ডের সদস্যরাই নয়। তার রয়েছে আরও কিছু গোপন অস্ত্র।” এইভাবে প্রথম আলো মার্কিন প্রপাগান্ডাকে বিচার না করেই ছেপে দেয়। আবার এই পাতাতেই আরেকটা রিপোর্ট কোথায় গেল ইরাকের গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র? শিরোনামে ছাপা হয়। যাতে বলা হচ্ছে, “ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কোনো হদিস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।” কন্ট্রাডিকশানের আরেকটি নমুনা দেই। সাদ্দাম নুইয়ে পড়ার মানুষ নন শিরোনামে ভারতীয় এক জেনারেল রানধাওয়া’র সাক্ষাৎকারভিত্তিক রিপোর্ট ছাপা হয়েছে ৩১শে মার্চ প্রথম পাতায়। সেখানে বলা হচ্ছে, “সাদ্দামের হাতে রাসায়নিক অস্ত্র নেই এটা ভাবা বোকামি। তবে তার বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্র নির্বিচারে ইরাকিদের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ না চালালে ইরাক জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না।” এই রিপোর্টটিই আবার ২রা এপ্রিল ছাপা হয়েছে সাদ্দাম কখনোই আত্মসমর্পণ করবে না শিরোনামে। একই রিপোর্ট দুইবার ছাপানোর এরকম ঘটনা আরও ঘটেছে। ৭ই এপ্রিল ‘আক্রান্ত ইরাক’ (পৃ.-৩) এ ছাপা ইরাকে স্থায়ী সামরিক উপস্থিতির ইঙ্গিত দিল পেন্টাগন শিরোনামের রিপোর্টটিই একাই দিনে সপ্তম পাতায় ছাপা হয়েছে ইরাকে মার্কিন সৈন্য স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারে শিরোনামে। আবার, ৯ই এপ্রিল প্রথম পাতায় ছাপা সাদ্দামের খোঁজে বাগদাদের আবাসিক এলাকায় হামলা: ব্যাপক ধ্বংস নারী শিশুসহ নিহত ১৪ শিরোনামের খবর এবং সাদ্দাম কোথায় শিরোনামের খবরটির সারবত্তা একই। প্রথম আলো এমন আগ্রাসীভাবে এই হামলা আভার করে যে কোন্টা সত্য কোনটা প্রচারণা সে-বিচার করার সময় যেমন থাকে না তেমনই একই রিপোর্ট কয়বার ছাপা হলো সেই হুঁশও থাকে না। 

ইরাকে মার্কিন হামলা নিয়ে চার পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্র ছাপা হয় ৩০শে মার্চ। বিবিসির বরাত দিয়ে সেখানে ঘটনাপ্রবাহ: আক্রান্ত ইরাক শিরোনামে ইরাকের কুয়েত দখল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই ‘গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তালিকায় ইরাকে মার্কিন অবরোধ ও সেই অবরোধে ১৫ লাখ ইরাকির মৃত্যু, জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার মানবিক পরিস্থিতির রিপোর্ট, কুর্দিদের নাশকতা চালাতে মার্কিন সহায়তা প্রদান, নো-ফ্লাই-জোন করে নিয়মিত মার্কিনি বোমাবর্ষণ, অস্ত্রপরিদর্শক দলের ঘোষণা ও এরকম আরও অনেক ঘটনা বাদ পড়ে যায়। কেবল সেই ঘটনাগুলোই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ঘটনার তালিকায় থাকে যেগুলো মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ১লা এপ্রিল আবার এরকম একটা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, যার শিরোনাম ইরাক যুদ্ধ: প্রথম ১২ দিনের খতিয়ান। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড, পেন্টাগন ও ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এই রিপোর্টটি করা হয়েছে। সামরিক-বেসামরিক হতাহত, সাংবাদিকদের ওপর মার্কিন বোমাবর্ষণ, নিক্ষিপ্ত বোমার প্রকৃতি, বাগদাদে ধ্বংসযজ্ঞ, বেসামরিক এলাকায় বোমানিক্ষেপ এই খতিয়ানে নেই। বরং আছে সাদ্দামের বাঙ্কারের প্রকৃতির কথা, ৬০০ তেলকূপ দখলের কথা। আগ্রাসী মার্কিনিদের পক্ষের খতিয়ানের পাশাপাশি আক্রান্ত ইরাকের পক্ষ থেকে দেয়া খতিয়ানও তুলে ধরা যেত। বরং সেটাই স্বাভাবিক হতো। কিন্তু প্রথম আলো তা করে না। তবু এমন শিরোনাম রচনা করে যে দেখে মনে হয় উভয় পক্ষের দাবিগুলোই উঠে এসেছে।

৩রা এপ্রিল ‘আক্রান্ত ইরাক’ পাতায় ছাপা হয় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রিপোর্ট: ইরাকের মানবাধিকার পরিস্থিতি জঘন্য। কেন এই সময়েই মার্কিন সরকার রিপোর্টটি প্রকাশ করলো সেই প্রশ্ন না করেই প্রথম আলো ছেপে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য আরও অনেক দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জঘন্য। কিন্তু এই সময়ে কেবল ইরাকের কথাই বলাটা ভিন্ন অর্থময়তা নিয়ে হাজির হয়। এবং প্রথম আলোর কাছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশযোগ্য বিষয় বলে গণ্য হয়! এই একই তারিখে ‘আক্রান্ত ইরাক’ পাতায় প্রকাশিত মহিলা ও শিশুহত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের দুঃখপ্রকাশ শিরোনামের খবরটি কথাই ধরুন। সেখানে বলা হচ্ছে: “ইরাকে মার্কিন সেনাবাহিনীর চেকপয়েন্টে সাত মহিলা ও শিশু হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র নিহতদের পরিবারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। … জেনারেল মায়ার্স বলেন, ‘আমি গত সোমবার নিহত ইরাকিদের পরিবারের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করছি। তিনি আরও বলেন ‘ইরাকে সাদ্দাম শাসনের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিই এ ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।” ইরাকে হামলা চালানোর ঘটনাটাই একটা গুরুতর বর্বরতা এবং সাধারণ ইরাকিদের এরকম নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অসংখ্য ঘটেছে। সেগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র দুঃখ প্রকাশ করেনি। বরং সাধারণ নাগরিক হত্যাকাণ্ড তাদের পলিসিরই অংশ, মার্কিন মদদে ও তাদের নিজেদের হাতে পৃথিবীব্যাপী বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ হত্যা করার নজির আছে। আর যখন তারা দুঃখ প্রকাশ করার ভান করছে তখন সেটাকে প্রচারণা চালানোর সুযোগ হিসেবেও ব্যবহার করছে। ফলে দুঃখ প্রকাশের চেয়ে প্রচারণাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং প্রথম আলো সেই প্রচারণা চালানো এবং সেইসাথে দায় এড়ানোর সুযোগ করে দেয়। ৯ই এপ্রিল ‘আক্রান্ত ইরাক’ পাতায় সাদ্দামের প্রাসাদগুলো ধ্বংস না করার আহ্বান হাওয়ার্ডের শিরোনামের খবরটিতে বলা হয়: “তিনি গত মঙ্গলবার বলেন, সাদ্দামের প্রাসাদগুলো ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ চিহ্ন বহন করবে। … হাওয়ার্ড বলেন, প্রসাদগুলো সংরক্ষণ করতে হবে যাতে এগুলো দেখে জনগণ ভাবার সুযোগ পায়, কার শাসন থেকে তাদের মুক্ত করা হয়েছে।” আমরা জানি যে ইরাককে মুক্ত করার জন্য নয় শৃঙ্খলিত করার জন্যই মার্কিনিরা হামলা করেছে। কিন্তু প্রথম আলো ‘মুক্ত’ করার ধারণায়ও বিশ্বাস করে। তা না হলে হাওয়ার্ডের এই বক্তব্যকে খণ্ডন করে ইরাকিদেরকে উদ্ধৃত করা হতো।

১০ই এপ্রিল প্রথম আলোর লিড স্টোরির শিরোনাম বাগদাদ মার্কিন হানাদারদের দখলে। বলা হচ্ছে: “…শয়ে শয়ে ইরাকি পশ্চিমাদের সোল্লাসে স্বাগত জানিয়েছে। অনেকে দুই আঙুল উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ইরাক সরকারের এই পতন, মার্কিন বাহিনীর এই বাগদাদ দখলের একটাই অর্থ-জয় হয়েছে জনগণের।” রিপোর্টের এই অংশটা আমার বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘শয়ে শয়ে ইরাকি’ ছিল আসলে কয়েক ডজন ইরাকি। এই জয়কে কীভাবে ‘জনগণের জয়’ বলা চলে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস দমনের’ নামে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটায়, জনগণকে ‘মুক্ত’ করার নামে শোষণের পথ সুপ্রশস্ত করে। কিন্তু প্রথম আলোর কাছে যেন এর উল্টোটাই সত্য মনে হয়।

Iraq War March 2003 Locals flee the burning town of Basra in Southern Iraq as armoured elements of the Royal Scots Dragoon Guards reach the out skirts of the town.

তৈলাক্ত ত্রাণ: এই মানবিক সহায়তা বুশের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন

ত্রাণ শুধু ত্রাণ নয়। ত্রাণের সাথে জড়িত থাকে নিজেকে মানবিক ও মহান করে উপস্থাপনার বাসনাও। নিষ্ঠুরভাবে তেজষ্ক্রিয় বোমা যেখানে ফেলা হচ্ছে সেখানে আক্রান্তদের জন্য ত্রাণও বিতরণ করা হয়, নিশব্দে নয় সশব্দে। বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররাই কেবল ত্রাণ নিয়ে ভোট বাগানোর রাজনীতি করে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও করে। ২৩শে মার্চ ‘সারা বিশ্ব’ পাতায় এরকম একটি খবর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে খাদ্যসাহায্য বাড়াবে। এক জায়গায় বলা হচ্ছে, “..কিছু গমের পরিবর্তে দেয়া হবে চাল, যাতে ইরাকি জনগণ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী পেতে পারে। ভেনেম্যান বলেন, এই মানবিক সহায়তা জাতি হিসেবে আমাদের সহানুভূতি এবং একটি সমুদ্ধ ইরাকের প্রতি প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।” সহানুভূতি উপচে পড়া এই রিপোর্টটিতে কী সাহায্য করা হচ্ছে শুধু সেটুকু বললেই চলতো। কিন্তু প্রথম আলো মার্কিনিদের মানবিক আলোয় উপস্থাপনার দায়িত্বও নেয়। ২৪শে মার্চে ইরাকি শরণাথীদের জন্য ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার অনুমোদন করেছে বুশ শিরোনামের খবরটিতে বলা হচ্ছে, “ইরাকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর শক্তিপ্রয়োগের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে মানবিক সংকটের সৃষ্টি হবে। আর এসময় ইরাকি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে জরুরি ত্রাণ কাজের ব্যাপারটি মাথায় রেখে প্রেসিডেন্ট বুশ ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার অনুমোদন করেছেন।” এই রিপোর্টটিতে ব্যবহৃত ভাষা লক্ষ করার মতো। ইরাকিদের নিয়ে বুশের ‘গুরুতর মাথাব্যথার’ কথাও ত্রাণের অছিলায় বলে দেয়া হচ্ছে। ২৫শে মার্চেও আরেকটা রিপোর্ট করা হচ্ছে ত্রাণ নিয়ে, যার শিরোনাম ইরাকে শিগগিরই ব্যাপক ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে: বুশ। রিপোর্টটিতে বলা হচ্ছে: “সকালে আমাকে জানানো হয়েছে, ত্রাণসামগ্রী পাঠানো শুরু করা উচিত। আগামি ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ইরাকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপক সাহায্য পাঠানো শুরু করা দরকার। সাদ্দাম হোসেনের অধীনে দীর্ঘ সময় ধরে যারা দুর্ভোগের শিকার হয়েছে তাদের অনেকের জন্য এটা অত্যন্ত সুখবর।” বুশের এই ‘সুখবর’ প্রচারের দায়িত্ব নেয়ার মাজেজা কী? প্রথম আলো সেটা বোঝে না ভাবলে ভুল হবে। তারা বোঝে এবং মার্কিন পলিসি অবস্থানের সাথে একমত বলেই এমন প্রচারে সহায়তা করে। মার্কিন অবরোধের কারণে অপুষ্টিতে-অনাহারে ইরাকে ৫ লাখ শিশু প্রাণ হারিয়েছিল। তখন কিন্তু ইরাকের শিশুদের প্রতি, নারীদের প্রতি মার্কিনিদের কোনো সহানুভূতি দেখা যায় নি। ইরাকিদের জন্য তারা কোনো ‘সুখবরও’ বয়ে নিয়ে যায়নি। এবং তাদের সাথে তাল মিলিয়ে মিডিয়াও এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুরো চেপে গেছে। মার্কিনি উদাসীনতা ও মিডিয়ার আনুগত্য বোঝার জন্য এডায়ার্ড এস. হারম্যানের মূল্য হিসেবে এটা ঠিকই আছে লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিই:

“১৯৯৬-এর ১২মে ৬০ মিনিট অনুষ্ঠানটিতে লেসলি স্টহল এর এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মেডিলিন অলব্রাইট এভাবে উত্তর দেন:

স্টহল- আমরা শুনেছি ৫ লক্ষ শিশু মারা গেছে (ইরাকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে)। আমি বলতে চাচ্ছি যে, হিরোশিমার চেয়েও এই শিশুমৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এবং আপনি কি মনে করেন, এই মূল্য ঠিকই আছে?

অলব্রাইট- এ-প্রশ্নের জবাব দেয়া খুবই দুরূহ। যে মূল্য… আমরা মনে করি লক্ষ্য পুরণের মূল্য হিসেবে এটি ঠিকই আছে।

‘গণহত্যার নিষেধাজ্ঞা’র এমন কুপ্রভাব দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ইরাকে কর্মরত ডেনিস হেলিডের মতো জাতিসংঘের যেসব কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন তাদেরকেও জনগণকে জানানোর জন্য ও নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য মিডিয়াতে খুব সামান্য জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।” (মানুষ সন্ত্রাস-মিডিয়া-যুদ্ধ সংখ্যা, পৃ. ৩৫৪)।

প্রাধাণ্যশীল ধারার গণমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবীরা এরকম গণহত্যাকে মেডিলিন অলব্রাইট কর্তৃক ন্যায়সঙ্গত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টিতে মনোযোগ দেয়নি। কিন্তু এখন যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখল করে নিতে অগ্রসর হয়েছে তাই সহানুভূতিও উপ্চে পড়ছে।

আর ইরাক দখল করতে যাওয়ার প্রধান একটা উদ্দেশ্য ছিল তেলসম্পদ কুক্ষিগত করা। যুদ্ধের শুরুতেই তারা মরিয়া হয়ে ৬০০ তেলক্ষেত্র দখলে নেয়। কারণ, এই তেলই হবে তাদের ‘সভ্যতার’ জ্বালানী। ডব্লিউ বুশ, কলিন পাওয়েল আর ডোনাল্ড রামস্ফেল্ড এই তিন মহারথীই তেল-ব্যবসায়ী একথা জেনে আশা করি আশ্চর্য হবেন না, যদিও প্রথম আলো এই খবরগুলো আমাদের দেয়নি। এই তেল খনিগুলো দখল-সংক্রান্ত একটা রিপোর্টের নমুনা দেখুন। ২৩শে মার্চ দক্ষিণ ইরাকের তেলখনিগুলো যৌথ বাহিনীর হাতে শিরোনামের খবরে বলা হচ্ছে: “তেলখনিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি পরিবেশ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে। ইরাকিরা এগুলোতে আগুন লাগানোর চেষ্টা করছিল। এটি আমাদের বড় ধরনের সফলতা।” ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়ামযুক্ত বোমা, ক্লাস্টার বোমা ইত্যাদি মার্কিন বাহিনী ব্যবহার করেছে নির্দ্বিধায়। তখন তাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা মনে হয়নি। যে-গণহত্যাযজ্ঞ তারা চালাচ্ছে তার জন্য কোনো অনুশোচনা তাদের জাগে না। কিন্তু তেলসম্পদ দখল করে তারা ‘পরিবেশ বিপর্যয়’ রোধের কৃতিত্ব নিতে চায়। প্রথম আলো সেই কৃতিত্ব তাদেরকে দেয়ও বটে।

‘নতুন প্রজন্মের মার্কিন জঙ্গী’ আর মিডিয়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মূলত অস্ত্রব্যবসা আর মিডিয়াব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। নির্মাণ-ঠিকাদারদের জন্য, অস্ত্রব্যবসায়ীদের জন্য আর মিডিয়ামালিকদের জন্য যুদ্ধ সমান সুফল বয়ে আনে। মার্কিন মুলুকে যে-মিডিয়া ‘গণতন্ত্রের’ কথা বলে সেই মিডিয়া বিদেশে যুদ্ধের প্রমোশন ঘটাতেও তৎপর থাকে। কারণ অধিকাংশ মিডিয়ামালিকই অস্ত্রব্যবসার সাথে জড়িত। এজন্যই তারা যুদ্ধের সুযোগে অস্ত্রের গুণাগুণও বর্ণনা করতে থাকে। আমাদের প্রথম আলোর মালিক ট্রান্সকম লিমিটেডের অস্ত্রব্যবসা না থাকলেও বহুজাতিক বণিকদের সাথে অন্যান্য ব্যবসা আছে। তাদেরই পণ্য ট্রান্সকম বাংলাদেশে বিক্রি করে। সেহেতু কৃতজ্ঞতাবশে প্রথম আলো বহুজাতিকদের অস্ত্রের ভাল দিকগুলোও পাঠককে জানিয়ে দেয়। ইরাকে হামলা-রিপোর্টিং শুরুর প্রথম দিনেই অর্থ্যাৎ, ২১শে মার্চ প্রথম আলোর লিড-স্টোরি বাগদাদে হামলা, টার্গেট সাদ্দাম-এ বলা হচ্ছে, “৮৭০ নটিক্যাল মাইল বা ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরত্বে হামলা করতে সক্ষম এই হাই সাবসানিক এফ-১১৭-এ নাইট হক …। বিশ্বের প্রথম অপারেশনাল এয়ারক্রাফ্ট এফ-১১৭-এ নাইটহকের রয়েছে ভয়ঙ্কর কম্ব্যাট ক্যাপাবিলিটি (যুদ্ধক্ষমতা)। দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই ফাইটার জেটে আরোহী বলতে কেবল একজন ক্রু থাকে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির দৃষ্টান্তবাহী এই ফাইটার জেট অনেক সময় নিজ থেকেই শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে পারে। রাডারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর গতিবিধি শনাক্ত করতে পারে না।” এই স্টেরিতেই আবার বলা হচ্ছে: “১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্রুজ মিসাইল স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত ছিল। এবার ৯০ শতাংশ মিসাইল স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত। এ কারণেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা একবারেই নেই।” ২২শ মার্চ প্রথম আলোয় উড়ন্ত বি-৫২ বোমারু বিমানের ছবি ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায় এবং তারই নিচে দক্ষিণ ইরাকে সম্মুখযুদ্ধ শিরোনামের লিড-স্টোরিতে বলা হচ্ছে, “গতকালই ব্রিটেন থেকে আটটি বি-৫২ বোমারু বিমান সম্ভবত উপসাগরের দিকে যাত্রা করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমারু বিমানের অন্যতম এই বিমান একই সঙ্গে ২০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে।” এই দুই দিনের হামলায় ইরাকে যে হতাহত হয়েছে তাদের কোনো বিবরণ পত্রিকার পাতায় নেই কিন্তু হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে এভাবে যুদ্ধাস্ত্রর গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে। ২৪শে মার্চেই দেখুন আরেকটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়: ইরাকের বিরুদ্ধে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ‘স্টর্ম শ্যাডো’। রিপোর্টটিতে বলা হচ্ছে, “ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত এই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রটি নির্দিষ্ট সময়ের আগেভাগেই ইরাক যুদ্ধে ব্যবহার করা হলো।… একটি স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের দাম পড়ে সাড়ে ৭ লাখ পাউন্ড। এই ক্ষেপণাস্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম। বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য এ ক্ষেপণাস্ত্র ২৩০ কিলোমিটার দূরে থেকেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। … প্রতিটি স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন ১ হাজার ৩৫০ কেজি।” হামলার বিভীষিকাকে আড়াল করে দিতে এধরনের বর্ণনা বেশ কাজে দেয়। স্টর্ম শ্যাডোর ওজন কতো কেজি তা বাংলাদেশের পাঠকদের জানার দরকার যতোটা তারচেয়ে অনেক বেশি জানা দরকার আক্রান্তদের অবস্থা এবং আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রযুক্তির বিস্ময় যুদ্ধকে পাঠকের সামনে ভিন্ন এক স্বাদ এনে দেয়। ৭ই এপ্রিল ‘আক্রান্ত ইরাক’ পাতায় ছাপা হয়েছে নতুন প্রজন্মের মার্কিন জঙ্গিবিমান: এক্স-৪৫ ও ইউ ক্যাভ শিরোনামের খবর। সেখানেও এই বিমানের গুণাগুণ, কারা তৈরি করেছে এই সকল খুঁটিনাটির বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

জীবন-বলি: গুরুত্বপূর্ণ বনাম গুরুত্বহীন

‘ইসরাইলীদের হাতে যখন প্রতিপক্ষ নিহত হয় তখন রয়টার্স কিংবা সিএনএন কিংবা অতি সম্প্রতি তাদের মতোই ধুসর সাংবাদিকতায় নাম লেখানো বিবিসি’র দৃষ্টিতে সেটাকে হত্যাকাণ্ড কিংবা গুপ্তহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় না। ইসরাইলীরা যা ঘটাচ্ছে সেটাকে কেবল ফিলিস্তিনীরাই “গুপ্তহত্যা” হিসেবে “আখ্যায়িত’ করছে বলে প্রচার করা হয়। যখনই ইসরাইলীরা জড়িত থাকে তখন আমাদের সত্য রিপোর্ট করার ক্ষমতা, আমাদের নৈতিক ভাবনার পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে যায়।…যখন কোনো ইসরাইলী মারা যাচ্ছে তখন ফিলিস্তিনীরা হত্যা করেছে বলে প্রতিনিয়ত রিপোর্ট করা হচ্ছে কিন্তু যখন দশ বছরের ফিলিস্তিনী শিশুও মারা যায় তখন সেটাকে “সংঘাতে” মৃত হিসেবে রিপোর্ট করা হয়- যেন এই “সংঘাত” ভূমিকম্প বা বন্যার মতো কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো নেমে আসে; যেন এই ট্রাজেডির জন্য কেউ দায়ী নয়।’ বড় এই উদ্ধৃতিটি দিলাম ব্রিটেনের অবজারভার পত্রিকার খ্যাতিমান সাংবাদিক বরার্ট ফিস্কের যখন সাংবাদিতরা ভুলে যান হত্যা হত্যাই লেখাটিতে থেকে। (মানুষ সন্ত্রাস-মিডিয়া-যুদ্ধ সংখ্যা, পৃ. ৩৪৯)

ইরাকের ক্ষেত্রেও আমরা এই একই চলন লক্ষ করি। এইসব মহান(?) মিডিয়াসংস্থার অনুকরণকারী আমাদের প্রথম আলোয় ইরাকে আগ্রাসন কাভারেজে এরকম ঘটনা ঘটে কিনা তা যাচাই করা যেতে পারে। এজন্য ২৬শে মার্চ প্রথম আলোর ‘আক্রান্ত ইরাক’ পাতায় ইরাকে নিখোঁজ মার্কিন মহিলা সেনার পিতার আকুতি: যেভাবেই হোক আমার জেসিকাকে দেশে ফিরিয়ে আনো শিরোনামের খবরটির প্রতি মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। খবরটিতে বলা হচ্ছে,“ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার উইট কাউন্টির চার্লেপ্টন থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে প্যালেস্টাইন নামক স্থানে জেসিকার বাড়ি। এখানে বেকারত্বের হার শতকরা ১৫ ভাগ। অন্য কোনো চাকুরিতে তেমন কোনো সুযোগ না পেয়েই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। …সোমবার তার বাড়ির চিঠের বক্সর সামনে একটি হলুদ ফিতা বেঁধে দেয়া হয়েছে। …জেসিকার চাচাতো বোন লরেনি কামব্রিজ বলেন, পরিবারের সদস্যরা তাকে জেসি নামেই ডাকত। তার বাড়িতেই বড় হয়েছে জেসিকা। তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলাম সে বড় হয়ে স্কুল শিক্ষক হবে।” এধরনের বর্ণনা পাঠ করার পরে আপনার নিশ্চয় জেসিকে অত্যন্ত কাছের মনে হবে। তার বাড়ির পরিবেশ চেনা লাগবে। তার অন্য কোনো ভাল চাকুরি না-পওয়া নিয়ে আপনার দুঃখ হবে। এই অনুভূতিগুলো আপনার না-হলেও আপনি রিপোর্টটি পড়ে অন্তত তার নামটি মনে রাখবেন।

উল্টোদিক থেকে ভাবুন, সে কোথায় গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে? প্রায়-নিরস্ত্র একটি দেশে অবৈধভাবে বর্বর হামলা চালানোর জন্য আগ্রাসী বাহিনীর সদস্য হিসেবে। যদিও নুরেমবার্গ নীতিতে বলা হয়েছে, একজন সৈন্য হিসেবে একটা অবৈধ যুদ্ধে লড়াই না-করার দায়বদ্ধতা একজন সৈন্যের রয়েছে। অসংখ্য মানুষ, যার মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিবও রয়েছেন, মনে করেন এই যুদ্ধ অবৈধ। কিন্তু জেসিকা এই অবৈধ্য যুদ্ধে লড়তে অস্বীকার করেনি। আগ্রাসনকে সহায়তা করেছে। আর তাকে নিয়েই প্রথম আলো এতোটা মমতাময় কাভারেজ দিয়েছে। কিন্তু স্বদেশকে রক্ষায় প্রণদানকারী ইরাকি সৈন্যদের নিয়ে আপনি এরকম একটা রিপোর্টও খুঁজে পাবেন না প্রথম আলোর পাতায়। তারা সব নামহীন, অদলহীন, পরিচয়হীন। তাদের নাম জানবেন না, তাদের বাবা-মার আকাঙ্খা কি তা জানবেন না, তারা কয় ভাইবোন তাও জানবেন না।

২৮শে মার্চ দেখুন ‘আক্রান্ত ইরাক’ পাতায় মৃত বাবাকে উদ্দেশ্য করে এক মার্কিন সেনার চিঠি শিরোনামে একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। পুরো চিঠিটাই এই রিপোর্টে উদ্ধৃত করা হয়েছে। ২রা এপ্রিল দেখুন আরও দুটো রিপোর্ট ছাপা হয়েছে ইরাকে মার্কিন সেনাদের জন্য ত্বকের লোশন এবং সিগারেটের মজুদ শেষ তাই মাথাখারাপ মেরিন সেনাদের শিরোনামে। ৯ই এপ্রিল ‘আক্রান্ত ইরাক’ পাতায় প্রকাশিত বসরায় নিহত ব্রিটিশ সৈন্য: দেশের জন্য জীবন দিয়েছে শুনে শান্তি পেয়েছে পরিবার রিপোর্টে বলা হচ্ছে, “গত সোমবার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কেলুন তুরিংটন (১৮) বসরায় নিহত হয়। সে কেমব্রিজের হাসলিংফিল্ড এলাকায় বাস করত। তার মা এন, বাবা কালিং এবং ১৫ বছর বয়সী ভাই লিয়াম বলেছে, ‘তারা জেনে শান্তি পেয়েছে যে, কেলুনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কেলুন চার বছর বয়স থেকেই সৈন্য হতে চেয়েছিল। আমরা তার মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা করিনি এবং অন্য কিছুর ব্যপারেও উৎসাহিত করিনি।” ব্রিটেনের দেশাত্ববোধক কোনা পত্রিকায় ব্রিটিশপ্রীতিমূলক এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না। প্রথম আলোর পাতায় এধরনের রিপোর্ট দেখেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, পশ্চিমা-প্রচারণা-কৌশল এতো স্বাভাবিকভাবে আমাদের মগজের ওপর রাজত্ব করে যে এদেশের একটি প্রধানতম পত্রিকা প্রথম আলোও এটাকে গুরুত্বপূর্ণ আইটেম বিবেচনা করে।  

এই একই তারিখে শেষের পাতায় খুবই গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত যুদ্ধের ময়দানে ইরাকি শিশু রিপোর্টটিও আমরা দেখতে পারি। শিরানামটা পাঠককে প্রতারিত করে। শিরোনাম দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এটা যুদ্ধাক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমবেদনামূলক রিপোর্ট। কিন্তু না, এই রিপোর্ট ইরাকি শিশুদের হত্যাকে বরং বৈধতা দেয়। রয়টার্সের থেকে নেয়া এই রিপোর্টটি জন পিলজার তার জার্নালিজম? লেখায় বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে রয়টার্সের ‘গ্রথিত’ (এমবেডেড) একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে একটি খবর সারা দুনিয়ার সংবাদপত্রে ছাপা হয়। খবরটি ছিল দশ বছর বয়সের একটি ইরাকি বালকের নিহত হওয়ার ঘটনা। তাতে লেখা ছিল: ‘আমেরিকান এক সৈনিক মেশিনগানের সাহায্যে একটি বালককে গুলি করে … মৃতদেহটি একটি আবর্জনার নোংরা ¯তূপের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে।’ কিন্তু প্রতিবেদনটি ছিল হত্যাকারী ঐ সৈনিকের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। ‘একুশ-বছর-বয়সের কোমল-স্বরের সৈনিকটি’; কিম্বা ‘বন্দুক চালানোর জন্য তার মনে তেমন কোনো অনুশোচনা লক্ষ করা যায়নি, কারণ সে কোনো সাধারণ বালককে হত্যা করেছে বলে মনে করে না’। রয়টার্সের ভাষ্যমতে ইরাকে শিশুদেরকে ‘প্রায়শই গুপ্তচর, যোদ্ধা অথবা অস্ত্রসংগ্রাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে আমেরিকান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং সৈনিকেরা দাবি করছে যে, এসব শিশুদের হত্যা করার অধিকার তাদের রয়েছে।’ ইরাকিরা ‘কাপুরুষ’, হত্যাকারী সৈনিকটির এমনতর মন্তব্যও বিনা সমালোচনায় মেনে নেয়া হয়েছে। আমেরিকানরা যে হত বালকের মাতৃভূমির উপর আক্রমণ চালিয়েছে তার কোনো উল্লেখ তো প্রতিবেদনটিতে ছিলই না, বরং হত্যাকারীকে রক্ষা করতে সৈনিকদের একজন দলনেতার বক্তব্য সেখানে সংযুক্ত করা হয়েছিল। উক্ত প্রতিবেদনটিতে প্লাটুন-লিডারের একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। সেখানে তিনি আবেগ-আপ্লুত স্বরে জানান যে, ‘আপনার কি ধারণা শিশুটিকে হত্যা করার ব্যপারটি তাকে (সৈনিকটিকে) একটুও বিচলিত করেনি? আলবত করেছিল। বিষয়টি ভেবে আমিও শঙ্কিত বোধ করি। আর এর চেয়ে বড়ো কথা হল, তার স্থানে আমি হলে রাইফেলের ট্রিগার টানতে পারতাম কিনা সন্দেহ। কিন্তু দেখেন, ইরাকিরাও বা কেমন? কী করে তারা তাদের সন্তানদেরকে এমন ঘোরতর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে?’ প্রতিবেদনটি লেখার এ-পর্যায়ে বোধকরি রয়টারের সাংবাদিক ভেবেছিলেন যে, পাঠককূল তার খবরের এই অংশ পর্যন্ত পড়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করবেন। আর সে-কারণেই তিনি তার বক্তব্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এরপর আরও কিছু বাক্য যোগ করেন, ‘অন্যান্য সৈনিকদের মতো তিনিও (সেই হত্যাকারী সৈনিক) কোনো যুদ্ধে প্রথমবারের মত খুন করার কারণে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু, এখন তিনি অনেক বেশি পরিপক্ব একজন যোদ্ধা।’” (যোগাযোগ-এর এই সংখ্যায় ‘তাহলে এই হলো সাংবাদিকতা’ শিরোনামে লেখাটির অনুবাদ ছাপা হয়েছে)।

প্রথম আলোতে এই রিপোর্টটি, যা ইরাকি শিশুহত্যাকেও বৈধ্যতা দেয়, সম্পূর্ণটাই ছাপা হয়েছে রয়টার্সের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যে। বিপরীতদিকে দেখুন, বিবিসির বরাতে ১০ই এপ্রিল প্রথম আলোর সম্মুখ পাতায় প্রকাশিত সাদ্দাম হোসেনের রিপাবলিকান গার্ড কোথায় গেল রিপোর্টটি। সেখানে বলা হচ্ছে, “ইরাকি নিয়মিত বাহিনীর দুর্বল আচরণের …সবচেয়ে বড় কারণটি হলো একনায়কতন্ত্রের সমস্যা। মাইকেল ক্লার্কের মতে, ‘সাদ্দাম এবং তার পরিবার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছে তার দেশের জনগণকে নির্যাতন করতে। ফলে সেনাবাহিনী একটা নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ করার মতো শক্তি তাদের আর অবশিষ্ট ছিল না।’” ইরাকি শিশুহত্যা যেমন বৈধ্যতা পায় পূর্বের রিপোর্টটিতে তেমনই এই রিপোর্টে ইরাকি সেনাবাহিনীর পরাজিত হওয়ার এমন কারণকে সামনে টেনে আনা হয় যা ইরাকের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী। রিপোর্টটিতে বলা হয় না যে অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও অবরোধের মতো বস্তুগত করণেই ইরাকের সমরশক্তি একবারেই ছিল না। আর সেই তুলনায় ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনী ছিল শতগুণ বেশি শক্তিশালী।  

‘যুদ্ধ কারো কারো কাছে চুটিয়ে ব্যবসার সুযোগ’

প্রথম আলো মারফতই আমরা জানতে পেরেছি যে তাইওয়ানিজ একটি ফুড এন্ড বেভারেজ কোম্পানি বুশ ও সাদ্দামের ছবিসম্বলিত স্পেশাল চকোলেট বাজারে ছাড়ে, যা বাজারে খুব চলেছিল। তাই প্রথম আলো এই ছোট রিপোর্টটি এমন শিরোনামে ৩০শে মার্চ চার পৃষ্ঠার ‘আক্রান্ত ইরাক’ নামের বিশেষ ক্রোড়পত্রে প্রকাশ করে। এই ক্রোড়পত্র থেকেই জানা যায়, এমটিভির সিদ্ধান্ত। রিপোর্টটিতে বলা হয়: “ইরাকে যুদ্ধ, সৈন্য, যুদ্ধবিমান, বোমা, মিসাইল, রায়ট, মিছিল কিংবা যুদ্ধসংশ্লিষ্ট কিছু তো তারা প্রচার করবেই না, এমনকি যুদ্ধবিষয়ক কোনো গান, টাইটেল, ইমেজ সম্বলিত কোনো মিউজিক ভিডিও পর্যন্ত তারা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছে। এমটিভি কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছে ‘আমরা শুধু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানই প্রচার করব, যুদ্ধ দেখিয়ে দর্শকদের মনে কষ্ট দিতে চাই না।”

গানের চ্যানেল এমটিভির এরূপ সিদ্ধান্ত আমাকে বিস্মিত করে না। কারণ, বর্তমান পুঁজিবাদী যে-অর্থনীতির কালে আমরা বাস করছি তার দর্শনই হলো ভোগবাদী সমাজ নির্মাণ করা। “পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা সবচেয়ে ভাল কাজ করে যেখানে জনগণের বৃহত্তর অংশকে এমনকরে নৈতিকভাবে নিঃস্ব-দুর্বল করে ফেলা যায় এবং কার্যকরভাবে বিরাজনৈতিক করে ফেলা যায় যে-পরিস্থিতিতে তারা কোনোরকম ভাল সামাজিক পরিবর্তন যে সম্ভব এমন আশাও পরিত্যাগ করে ও জনজীবন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে সামাজিক পিরামিডের শীর্ষস্থানীয়দের হাতে সমাজের সকল বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজ ছেড়ে দেয়।” এমটিভি এই মতাদর্শ ছড়ানোর এজন্ট হিসেবে কাজ করে। এমটিভি যেমন ‘দর্শকের মনে কষ্ট না-দিয়ে’ নির্বিঘ্নে মুনাফার পথ সুগম রাখতে চায় তেমন করে কি ‘জনগণের পক্ষের’ সংবাদ মাধ্যমগুলো অন্যকোনো কৌশল অবলম্বন করে ‘চুটিয়ে ব্যবসা করতে’ চায় না? এর উত্তর হলো, হ্যাঁ তারাও ব্যবসা করতে চায়। কারণ, জন পিলজারের জার্নালিজম? লেখাটি থেকেই আমরা জানতে পারি, রয়টার্সের কাছে ইরাকের মূল্য ২০ মিলিয়ন পাউন্ড। অর্থাৎ, ইরাক যুদ্ধের খবর বিক্রি করে রয়টার এই পরিমাণ অর্থ মুনাফা লাভ করবে। প্রথম আলোর কতো মুনাফা হয়েছে সেখবর আমরা জানি না। কিন্তু প্রথম আলোর অধিক মুনাফা অর্জনে সহায়ত প্রষ্টোগুলো আমরা শনাক্ত করতে পারি।

ইরাকে মার্কিন হামলা কাভারেজের প্রথম দিনে অর্থ্যাৎ ২১শে মার্চের প্রথম আলোর প্রথম পাতায় কী সংবাদ ছাপা হয়েছে? পুরো পাতাটিতেই ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের খবর। কেবল একটা খবর অন্য প্রসঙ্গের। সেটা হলো ক্রিকেটের খবর, যার শিরানাম আবার টেন্ডুলকার-সৌরভ। পৃথিবীর অন্য সকল ঘটনাকে বাদ দিয়ে ক্রিকেটামোদীদের জন্য প্রথম পাতায় উঠে এসেছে এই খবরটি। একদিকে বর্বর যুদ্ধ পুরো পাতা জুড়ে, যা এমটিভির ভাষায় পাঠককে কষ্ট দেয়। আর সেই কষ্ট লাঘবের জন্য, যদি বলি, ‘আবার টেন্ডুলকার-সৌরভ’কে স্থান দেয়া হয়েছে তাহলে ভুল বলা হয় না। যুদ্ধটা বস্তুত ক্রিকেটের মতো বিংবা তার চেয়েও উত্তেজক।

প্রথম আলোর ‘আলপিন’-এর সম্পাদকীয়তে ৩১শে মার্চ ঘোষণা দেয়া হয়েছে, “…আলপিন এই যুদ্ধ থেকে দূরে নেই, তাই এবারে পুরো আলপিন যুদ্ধ নিয়ে।” তারপর পাঠককে আহ্বান করে সেখানে বলা হচ্ছে, “আমরা আগামি আলপিনও যুদ্ধ নিয়ে করতে চাই। তবে সে আলপিনে পাঠকের অংশগ্রহণ আমরা একান্তভাবে কামনা করি।” কিন্তু পাঠক কীভাবে অংশগ্রহণ করবে? বলা হচ্ছে, “আপনি এখনই কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়–ন এবং সবচেয়ে ভাল লেখাটি পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে।” ভাল লেখা বলতে আলপিন যা চাচ্ছে তা হলো, “সে লেখাটি হতে পারে বুশ-ব্লেয়ার নিয়ে কোনো রম্যরচনা, কোনো মজার আইটেম অথবা যেভাবে লিখতে চান- যা আলপিনে প্রকাশ হওয়ার মতো।” আলপিন হালকা-চটুল বিনোদন দিয়ে পাঠককে মাতিয়ে রাখতে চায়। সুতরাং প্রণঘাতী যুদ্ধ তাদের কাছে হয়ে ওঠে কেবলই ‘রম্যরচনা’ কিংবা কোনো ‘মজর আইটেম’। তাদের কাছে যুদ্ধ একটা খেলাও বটে, অতি উত্তেজক খেলা, সেটা আগেই বলেছি। কীভাবে সেই খেলা খেলতে হয় তা শিখতে হলে দেখুন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শিরানামের আলপিন-আইটেমটি।

প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ নামের যে সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয় তার ২৯শে মার্চ সংখ্যাটি ‘আক্রান্ত ইরাক’ বিষয়ে। সেখানে আপনি জানতে পাবেন, সাদ্দাম ও বুশের রাশিচক্র। “ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বৃষ রাশির জাতক পক্ষান্তরে জর্জ বুশ হচ্ছে কর্কট রাশির জাতক।” আরও জানতে পাবেন সাদ্দামের লাইফস্টাইল। তার শরীরচর্চা, খাবারের মেনু, প্রিয় ছবি ইত্যাদির খবর। যেন সাদ্দাম সিনেমার ‘হিরো’। যুদ্ধের সুযোগে এরকম অসখ্য ‘মজাদার আইটেম’ প্রথম আলো তার পাঠকের সামনে হাজির করে। 

প্রথম আলোতে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ছবি ছাপা হয়েছে, যা যুদ্ধের বিভীষিকা তুলে ধরে, পশ্চিমা বাহিনীর বর্বরতা তুলে ধরে। বেশ কিছু ভাল রিপোর্টও আমরা দেখি প্রথম আলোর পাতায়। আর অভিমত পাতায় যে-লেখাগুলোর অনুবাদ ছাপা হয়েছে তার অধিকাংশ লেখাই এই যুদ্ধকে বোধগম্য করে তুলোর জন্য খুবই উপযোগী। কিন্তু সাথে সাথেই বিবেচনায় রাখা দরকার যে প্রথম আলোতে পশ্চিমা প্রচারণাকেও নিভরযোগ্য সত্য হিসেবে তুলে ধরেছে। অধিকাংশ রিপোর্টে পশ্চিমা সংবাদসূত্রের জবানকেই আশ্রয় দেয়া হয়েছে যারা আক্রমণকারীর চোখে এই হামলার ‘ধারাভাষ্য’ দিয়েছে। এই বৈপরীত্য বিচারে নিয়ে এমন সিদ্ধান্তেই আসা যায় যে ইরাকে হামলার বিরুদ্ধে প্রথম আলোর অবস্থান নেয়ার দাবী বানোয়াট। তারা আগ্রাসীভাবে এবং প্রশ্নহীনভাবে, মূলত পশ্চিমা সূত্রমারফত, পাঠক খাবে এমন সকল কিছু তুলে ধরেছে। যার একটাই উদ্দেশ্য থাকতে পারে, মুনাফার থলেটাকে আরও ভারি করা। রয়টার্সের কাছে ইরাকের মূল্য ছিল ২০ মিলিয়ন পাউন্ড। প্রথম আলো কাছে ইরাকের মূল্য কতো আমরা জানি না। তবে এটা অন্তত জানি যে যুদ্ধ প্রথম আলোর কাছেও ‘চুটিয়ে ব্যবসার সুযোগ’ ভিন্ন আর কিছু নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *