ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব এবং অভ্যুত্থানের স্পিরিট রক্ষায় করনীয় প্রসঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রস্তাব

ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার

এই রাষ্ট্রের সংস্কার

প্রিয় দেশবাসী,
বিজয়ের অভিনন্দন।

আপনারা জানেন ২০১৪ সাল থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের শত শত নেতা-কর্মীকে গুম, ক্রসফায়ার, খুন, জেল, জুলুম, নির্যাতন করতে করতে বেপরোয়া খুনীরা নির্দলীয় নিরস্ত্র ছাত্রদেরও খুন করা শুরু করলে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়ে শহীদ হয় বেরোবির ছাত্রনেতা আবু সাঈদ। তারপর আর জীবন দেওয়ার মানুষের অভাব হয়নি। গত ১৬ জুলাই থেকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের উপর প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা। এই যুদ্ধ মোকাবেলা করে বিজয় অর্জন করতে গিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ক্রমেই ঐক্যবদ্ধ হতে হতে জাতীয় ঐক্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশ এই প্রথম একটি সরকার পেয়েছে, যে সরকার ছাত্রদের নেতৃত্বে জনতার অভ্যুত্থানের উপর প্রতিষ্টিত এবং যে সরকারে আন্দোলনকারী নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন আছে। এই অবস্থায় সকল পক্ষের উচিত হচ্ছে, এই বিজয় এবং ঐক্যকে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্যে রূপান্তর করে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। সে লক্ষ্যেই আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কয়েকটি প্রাথমিক দায়িত্ব, প্রধান দায়িত্ব এবং জবাবদিহিতা প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি সকলের বিবেচনার জন্য উত্থাপন করছি।

১। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব:
ক) বিজয়ের অব্যবহিত পর থেকেই কতিপয় রাজনৈতিক দলের নামে দেশের বহু জায়গায় সহিংসতা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং দখলবাজি করে গত কয়েকদিনে জনগণের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে। সরকার দ্রুততম সময়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

খ) জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনাকারী,
নির্দেশদাতা এবং নির্দেশ পালনকারীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করবেন এবং তাদের বিচারের আওতায় আনবেন।

গ) বিগত আমলের বিপুল দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচারের শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দুর্নীতি লুটপাটের বিচারের ব্যবস্থা এবং
পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করবেন।

ঘ) আয়নাঘর স্থায়ীভাবে বন্ধ করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের দ্রুত ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা এবং বিগত আমলের গুম ও ক্রসফায়ারের সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রণয়ন এবং এইসব জঘন্য অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি নিশ্চিত করবেন।

ঙ) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফার যেসব দাবী এখনো বাস্তবায়ন হয়নি সেগুলো এবং ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সড়ক ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

চ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানসহ কোনো উপদেষ্টা পরবর্তী ‘জাতীয় সংসদ’ নির্বাচনে যাতে অংশগ্রহণ করতে না
পারেন, সে বিধান করবেন।

প্রিয় বন্ধুগণ
আমরা জানি, শুধুমাত্র ফ্যাসিস্ট মাফিয়া শাসকদের সরানোর জন্য এতো মানুষ জীবন দেয়নি। তারা জীবন দিয়েছে এমন একটি ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে যাতে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে আর কোন শাসক এমন ফ্যাসিস্ট ও মাফিয়া জুলুমবাজ হয়ে উঠতে না পারে। এবং এবারের পরিবর্তন যাতে টেকসই হয়, জনগনের অনুমোদন ছাড়া, কয়েকজন বিচারপতি বা সংসদ সদস্য যাতে এবারের পরিবর্তনকে আদালতে বা সংসদে বসে নস্যাৎ করে দিতে না পারে। মানুষের সেই আকাঙ্খাকে স্থায়ী করার লক্ষ্যে আমরা অন্তবর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হিসাবে নীচের প্রস্তাবটি তুলে ধরছি।

২। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব:
ক) অন্তবর্তী সরকার, রাষ্ট্রের সংস্কারের জনআকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য ঐকমত্য তৈরীর লক্ষ্যে ১) আইন বিভাগ
বা সংসদ, ২) বিচার বিভাগ, ৩) আমলাতন্ত্র বা প্রশাসন, ৪) পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনী, ৫) নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, ৬) নির্বাচন ব্যবস্থা, ৭) রাষ্ট্র পরিচালনার আইন-কানুন, ৮) স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ৯) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ১০) মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা এবং ১১) ‘সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামো’সহ অন্তত ১১টি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত সংগ্রহের জন্য ‘টাস্কফোর্স গঠন’ এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে ‘গণ-আলোচনা’র উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

খ) টাস্কফোর্স প্রস্তাবিত এবং গণ-আলোচনার মাধ্যমে উত্থাপিত প্রস্তাবসমূহের সমন্বয়ে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য একটি ‘সংস্কার ফ্রেমওয়ার্ক বা রূপরেখা’ তৈরি করবেন।

গ) অতঃপর ‘সংস্কার ফ্রেমওয়ার্ক বা রূপরেখা’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘সংবিধান সংস্কার সভার’ নির্বাচন আয়োজন করবেন। এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ গঠন করবেন।

ঘ) গঠিত হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ ইতিপূর্বে গৃহীত ‘সংস্কার ফ্রেমওয়ার্ক বা রূপরেখা’ অনুযায়ী
সংবিধান সংস্কার করে একটি খসড়া প্রণয়ন করবেন এবং জনগনের অভিমতের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে গ্রহনের জন্য সে
খসড়াটি গণভোটে পেশ করবেন।

ঙ) গণভোটে পাশ হওয়া নতুন সংবিধানের অধীনে সরকার গঠনের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবেন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

বন্ধুগন,
বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোন সরকারই জনগনের বা জনগনের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করে নাই। আমাদের প্রায় সকল সমস্যার মুলে জবাবদিহিতাহীন সরকার ব্যবস্থা। তাই নতুন রাজনীতি, নতুন ব্যবস্থ্যা শুরু করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্টার মাধ্যমে। সে লক্ষ্যে আমাদের তৃতীয় প্রস্তাব।

৩। সরকারের জবাবদিহিতা:
ক) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকারী সংস্থা বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নিয়ে একটি ‘জাতীয় শিক্ষার্থী কাউন্সিল’ গঠন করতে হবে।

খ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দেয়ার ক্ষমতা থাকবে উক্ত কাউন্সিলের হাতে। এবং সরকারের যেকোনো পর্যায়ে ‘অভ্যুত্থানের স্পিরিট পরিপন্থী’ কোন কর্মকান্ড ঘটলে কাউন্সিল বিধান অনুযায়ী বিরোধিতা এবং ব্যবস্থা গ্রহণে প্রস্তাব করতে পারবে।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
১১ আগস্ট, ২০২৪
ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে এবং স্পিরিট রক্ষায় ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকতে হবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *